প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ প্রায় ১৭ টাকা। অথচ কৃষকরা এখন বিক্রি করছেন ৭-৯ টাকা কেজিতে।
গতবারের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি জমিতে আলু চাষ হলেও এবার দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।উৎপাদন খরচের তুলনায় আলু বিক্রি করছেন প্রায় অর্ধেক দামে। এর পাশাপাশি কোল্ড স্টোরেজের ভাড়াও বেড়েছে। খবর টিবিএস
সার্বিকভাবে এবার আলু চাষে লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদকৃত তথ্যে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৭.২৬ টাকা। জমি তৈরি, সার, বীজ, শ্রমিক, সেচ, কীটনাশক, জমি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বিবেচনায় নিয়ে এ উৎপাদন খরচ নিরূপণ করা হয়।
তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে প্রতি কেজি আলু ৭-৯ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকরা। এরপর বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় পাইকারিতে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১৫-১৭ টাকা। আর খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়।
বগুড়ায় বর্তমানে জাতভেদে প্রতি মণ (৪২ কেজি) আলু বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকায়। এতে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ছে সাড়ে ৭ টাকা থেকে ৯ টাকা।
বগুড়া জেলার মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আলু চাষ হয়।
আলীগ্রামের কৃষক নাফিসুল ইসলাম গনমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে আলু চাষ করতে খরচ হয়েছে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। গড়ে ৯০ মণের মতো এবার ফলন হতে পারে।
সে হিসাবে, প্রতি মণে প্রায় ৪৫০-৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম এর অর্ধেক। এ কারণে এখনও তুলিনি। আরও কয়েকদিন পর তুলে কোল্ড স্টোরেজে রাখব।
কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া বৃদ্ধি আরেক দফা চাপ সৃষ্টি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছর বস্তা ৩৫০ টাকায় রাখতাম। ৫০ কেজির বস্তায় ৬৫ কেজি আলু ধরত।
কিন্তু এবার কেজিতে ৮ টাকা দিতে হবে। ৮ টাকা স্টোরেজ ভাড়া দিয়ে পরে কয় টাকায় আলু বিক্রি করতে পারি, বলতে পারছি না।’
একই কথা জানিয়ে ফেনিগ্রামের আব্দুল হামিদ বলেন, ‘পাকড়ি ও স্টিক আলু চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় পাকড়ি ৬৫-৭০ মণ এবং স্টিক ৯০ মণের মতো হবে।
আমার প্রতি বিঘায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তবে যারা বীজ কিনে আলু চাষ করে তাদের খরচ আরও অনেক বেশি।
গত বছর আলুর দাম বেশি ছিল, এ কারণে বেশি জমিতে আলু চাষ করেছি। কিন্তু এই দামে আলু চাষ করলে কৃষক নিঃস্ব হয়ে যাবে।’
গত বছরের বেশিরভাগ সময় আলুর দাম ছিল অস্বাভাবিক বেশি। ফলে বাড়তি লাভের আশায় কৃষকরা আলু চাষ বেশি করেছেন। তবে এখন উৎপাদন খরচও ওঠাতে পারছেন না তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি মৌসুমে ৪.৬৭ লাখ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।
তবে এরই মধ্যে আবাদ হয়েছে ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৭ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আলুর আবাদ হয়েছিল ৪.৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার ৬৭ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে পুরো মার্চ মাসজুড়ে মূল মৌসুমের আলু উত্তোলন করেন কৃষকরা।
তবে গত বছর আলুর ভরা মৌসুমেই দাম ছিল বেশি। এরপর মে মাসে তা ৫০ টাকা পেরিয়ে যায়। নভেম্বরে আলুর দাম দাঁড়ায় কেজিতে ৮০ টাকা, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার নাগদাহ গ্রামের কৃষক আবু তাহের বলেন, ‘এখন আমাদের এলাকায় প্রতি কেজি আলু ১০-১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আগে ৮ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। গত দুই দিন ধরে কিছুটা বাড়তির দিকে। তবে ২০ টাকার নিচে হলে কৃষকদের লোকসান হবে।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম গনমাধ্যমকে বলেন, ‘যে বছর দাম বেশি থাকে এর পরের বছর কৃষকরা সে ফসল বেশি করেন।
আবার দাম কম থাকলে পরের বছর কম ফসল করেন। এটা কমন সমস্যা। এখন ফলন বেশি হলে আবার দাম কমে যায়।
‘এজন্য আলুর ক্ষেত্রে ভ্যালু অ্যাড করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত গ্রুপ মার্কেটিংয়ে ফোকাস করতে হবে। অর্থাৎ ১০ জন কৃষক আলু চাষ করেন; এর মধ্যে একজন সেগুলো বাজারজাত করবেন। এতে সরাসরি বাজারের সঙ্গে কৃষকরা যুক্ত হবেন।’
নেপালে ৩৩৬ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি
বাংলাদেশ থেকে আরও ৩৩৬ মেট্রিক টন আলু নেপালে রপ্তানি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে আলুভর্তি ১৬টি ট্রাক নেপালে পাঠানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধি মোমিন।
তিনি গনমাধ্যমকে জানান, আমরা আজকে থিংকস টু সাপ্লাই নামের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩৩৬ মেট্রিক টন আলু নেপালে পাঠিয়েছি। আলুগুলো রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকার। আমরা এর আগেও বেশ কয়েকবার নেপালে আলু রপ্তানি করেছি।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কোয়ারিনটিন ইন্সপেক্টর উজ্জল হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, আজকেও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ৩৩৬ মেট্রিক টন আলু নেপালে গেছে। এগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে।
স্থলবন্দর সূত্রে জানা যায়, ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে ট্রানজিট সুবিধা থাকায় ব্যবসা ও পর্যটনে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করেছে স্থলবন্দরটি। স্থলবন্দরটিতে ৯৫ শতাংশই পাথর নির্ভর হলেও বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ভারত ও নেপালে।
বন্দরটি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারত ও নেপালে পাট, ওষুধ, প্রাণ ও ওয়ালটনের পণ্য, জুস, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। অপরদিকে মসুর ডাল, গম, ভুট্টা, চিরতা, হাজমলা, যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক দানা, রেললাইনের স্লিপার, খইল, আদা ও চিটাগুড় আমদানি করা হয়।
১৯৯৭ সালে নেপালের সঙ্গে এক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে প্রথম আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়। ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে ও ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে বন্দরটি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মেট্রিক টন পাথর আমদানি হচ্ছে। প্রায় ১০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.