৪৪ বছরে সাত গুণ নগরায়ণ, ৫টি এলাকা ‘ট্রি-ডেজার্ট’ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্ধেক গাছ হারিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে রাজধানী।
নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা শহরের পরিবেশগত ভারসাম্য চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে গত চার দশকে। ১৯৮০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নগরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেড়েছে সাত গুণ।
এ সময় ভূমির গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হারিয়ে গেছে ৬০ শতাংশ জলাধার ও অর্ধেকের বেশি গাছপালা। এই বিপর্যয়ের চিত্র উঠে এসেছে নাগরিক গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ–এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায়।
রোববার ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘প্রকৃতিবিহীন ঢাকা? প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক টেকসই নগর ভাবনার পুনর্বিচার’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা শহর: এক সংকটাপন্ন নগরীর গল্প
গবেষণায় ১৯৮০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইট চিত্র ও তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়:
- ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেড়েছে ৭ গুণ।
- সবুজ আচ্ছাদন কমে এসেছে ২১.৬% থেকে ১১.৬%।
- ৬০% জলাধার বিলুপ্ত, অবশিষ্ট মাত্র ৪.৮% এলাকায়।
- ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে ৩-৫°C।
- ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে কোনো এলাকার অস্তিত্ব নেই।
বিশেষত আদাবর, রামপুরা, কাফরুল, বংশাল ও ওয়ারী এলাকাগুলোতে গাছপালা প্রায় নেই। জলাধার হারিয়ে সূত্রাপুর, মিরপুর, গেণ্ডারিয়া ও কাফরুল এখন পানিশূন্য এলাকায় পরিণত হয়েছে।
উষ্ণ ঢাকায় বাস: হটস্পট ও ঝুঁকি
ঢাকার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে: শ্যামপুর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা, দারুস সালাম। এই এলাকাগুলোতে তাপমাত্রা নিয়মিতই ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। ৫০টি থানার মধ্যে ৩৭টি ইতোমধ্যে নিরাপদ নির্মাণ সীমা অতিক্রম করেছে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ বলছে, এটি শুধু নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা নয়—এ এক প্রকার পরিবেশগত অবিচার, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও অধিকার হুমকির মুখে ফেলছে।
সমাধানের পথ: প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনা
গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার প্রতিটি নাগরিকের জন্য কমপক্ষে ৯ বর্গমিটার গাছপালা ও ৪.৫ বর্গমিটার জলাধার নিশ্চিত করা গেলে গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.০১°C কমানো সম্ভব।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বলেন, “২০৩৫ সালে ঢাকায় প্রায় ২.৫ কোটি মানুষের বসবাস হবে। আমরা এখন এমন এক নগরে বাস করছি যেখানে প্রকৃতির জন্য কোনো জায়গা নেই। সিঙ্গাপুর, সিউল, এমনকি দিল্লি বা জাকার্তার মতো শহরগুলো প্রকৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে, অথচ আমরা আরও পিছিয়ে পড়ছি।”
প্রস্তাবিত ১৫টি পদক্ষেপ: স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা
স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ:
- জলাভূমি ও বনভূমি ভরাটকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন প্রণয়ন।
- ড্যাপ (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) পরিবেশগত সংকটপূর্ণ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে হালনাগাদ করা।
- কংক্রিট কাঠামোর উপর ৫ গুণ কর আরোপ।
- জলাশয় পুনরুদ্ধার এবং পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বাধ্যতামূলক করা।
- গোষ্ঠীগত তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ।
মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ:
- প্রকৃতিবান্ধব নগর পরিকল্পনা ও সবুজ বিনিয়োগে অগ্রাধিকার।
- প্রকৃতিবঞ্চিত অঞ্চলে ৫৬.৫ বর্গকিমি বৃক্ষরোপণ।
- জলাভূমি ও বাফার জোন পুনরুদ্ধার।
- তাপ ও পানি সংকটপূর্ণ থানাগুলোকে উন্নয়ন অগ্রাধিকার দেওয়া।
- ডিজিটাল জবাবদিহিতা ও প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
সতর্ক বার্তা: ঢাকার ‘ফুসফুস’ হারিয়ে যাচ্ছে
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, “কোনো শহর তার নিজের ফুসফুস বন্ধ করে টিকে থাকতে পারে না। প্রকৃতি যদি না বাঁচে, আমরাও টিকতে পারব না।”
শেষ কথা: এখনই পদক্ষেপের সময়
ঢাকা শহর কংক্রিটের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে। জলাধার ও গাছপালাহীন একটি শহর জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অক্ষম। ঢাকাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই প্রকৃতি-অধিকারভিত্তিক নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.