পরিবহন ঠিকাদার-ডিলারদের কারসাজিতে বিপাকে কৃষক।
নিজস্ব প্রতিবেদক:
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সারের বাজার সিন্ডিকেটের দখলমুক্ত হয়নি। পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম আদায় করছে। এতে সরকারের কৃষি উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে এবং ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সিন্ডিকেট চক্রের চিত্র
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫০ কেজির ডিএপি সারের সরকারি মূল্য ১,০৫০ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ১,৪০০ থেকে ১,৭০০ টাকায়। এতে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছেন।
প্রতিবেদনটি কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মৌসুমভিত্তিক চাহিদা ও সিন্ডিকেটের কারসাজি
বাংলাদেশে বছরে তিন মৌসুমে সার লাগে—
- রবি মৌসুম (নভেম্বর-মার্চ): ৪০% সার
- আউশ মৌসুম (এপ্রিল-জুলাই): ৩০% সার
- আমন মৌসুম (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর): ৩০% সার
চাহিদা অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় সার বিতরণ হলেও অসাধু ডিলাররা গুদাম থেকে সার না তুলে সংকট সৃষ্টি করছে। ফলে কৃষকদের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।
দেশে সারের মজুত পর্যাপ্ত, তবুও সংকট
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সারাদেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। এর ৮০ শতাংশ আমদানি ও ২০ শতাংশ স্থানীয় উৎপাদন থেকে আসে।
বর্তমানে মজুত আছে—
- ৬ লাখ ৩০ হাজার টন ইউরিয়া
- ২ লাখ ১৭ হাজার টন টিএসপি
- ২ লাখ ৭৩ হাজার টন ডিএপি
- ২ লাখ ৮১ হাজার টন এমওপি
অতিরিক্ত আরও প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার টন সার সমুদ্রপথে দেশে আসছে। অথচ ডিলার-পরিবহন সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।
আমদানিতেও বিলম্ব, বাজারে প্রভাব
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার আমদানি প্রক্রিয়ায় ছয় থেকে আট মাস সময় লাগে। কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে জাহাজ থেকে সার খালাসে বিলম্ব করে, ফলে বাজারে ঘাটতি তৈরি হয় এবং দাম বেড়ে যায়।
ডিলারশিপে রাজনৈতিক প্রভাব
দেশে বর্তমানে ৭,১৫০ জন ডিলার আছেন—বিএডিসির ৫,০২২ জন এবং বিসিআইসির ২,১২৮ জন। অনেক ডিলার একই ব্যক্তি ভিন্ন নামে একাধিক ডিলারশিপ নিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত।
অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সাল ইমাম বলেন— “যারা অনিয়মে জড়িত তাদের লাইসেন্স বাতিল হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় আনা হবে। সার ডিলার নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করা হচ্ছে।”
কৃষকের আক্ষেপ: নির্ধারিত দামে সার পাওয়া যায় না
চুয়াডাঙ্গার কৃষক মিনারুল ইসলাম বলেন— “ছয় বিঘা জমির জন্য ১৮০ কেজি সার দরকার। অথচ ডিলারের কাছ থেকে পেয়েছি মাত্র ৬০ কেজি। বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হয়েছে।”
আরেক কৃষক আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন— “প্রতি মৌসুমে একই সংকট। সময় মতো সার না পেলে চাষ করবো কীভাবে? এটা পরিকল্পিত সংকট।”
খুচরা ব্যবসায়ী ও ডিলারদের বক্তব্য
খুচরা সার ব্যবসায়ী আলমগীর হাসান জানান, “কৃষকের চাহিদা মেটাতে বাইরের জেলা থেকে সার আনতে হচ্ছে। তাই দাম কিছুটা বেড়েছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিলার স্বীকার করেন, “সব কৃষক একসঙ্গে সার নিতে চাইছে। তাই কম করে দিতে হচ্ছে।”
সংকট নিরসনে ১২ দফা সুপারিশ
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সারের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী সারের সরবরাহ নিশ্চিত করা
- ডিলার-পরিবহন সিন্ডিকেট ভেঙে নজরদারি জোরদার করা
- একই ব্যক্তি ভিন্ন নামে একাধিক ডিলারশিপ বন্ধ করা
- রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে ডিলার নিয়োগ করা
- উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন জেলায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.