বদলে যাচ্ছে বন্যার সময়, কৃষিতে বিরূপ প্রভাব

স্টাফ রিপোর্টার

‘বান হইলে যে ক্ষতি হয়, না হইলে আমগো তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।’—কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কৃষক মতিয়ার এভাবেই প্রকাশ করলেন তার দুঃখের কথা। সময়মতো বন্যা না হওয়ায় চরাঞ্চলের ধান, কালাই আর বাদাম আবাদ ব্যাহত হচ্ছে।

কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, সময়মতো বন্যা না হলে জমির উর্বরতা কমে যায়। আবার বিলম্ব বন্যা হলে ফসল তলিয়ে যায়। কৃষি বাঁচাতে সময়মতো মৌসুমি বন্যা হওয়া দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

কৃষি ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশের বন্যার প্রকৃতিতে। মৌসুমি বন্যার বদলে বাড়ছে আকস্মিক বন্যার প্রবণতা। এর প্রভাবে কৃষকরা সময়মতো রবি ফসলের জমি প্রস্তুত করতে পারছেন না।

পাউবো’র তথ্যমতে, ২০২২ সালে জুনে কুড়িগ্রামে প্রধান নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে বন্যা হয়েছিল। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে একাধিক দফায় জুন-জুলাইয়ে বন্যা দেখা যায়। তবে ২০২৫ সালে জুন-জুলাই পেরিয়ে আগস্টেও বন্যার দেখা মেলেনি।

বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন

  • ২০২৩ সালে কুড়িগ্রাম গেজ স্টেশনে জুনে বৃষ্টিপাত ছিল ৫১৮ মিমি, জুলাইয়ে ১৪৫ মিমি।
  • ২০২৪ সালে জুনে ১ হাজার ৯৮ মিমি ও জুলাইয়ে ৬১৬ মিমি।
  • ২০২৫ সালে জুনে কমে দাঁড়ায় ২৫৯ মিমি, জুলাইয়ে ৩৯৬ মিমি।

চিলমারী স্টেশনের পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক। এ বছর জুনে মাত্র ১৮ মিমি ও জুলাইয়ে ২৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

কৃষকদের দিশেহারা অবস্থা

কৃষক রায়হান আলী বলেন, ‘ধান রোপণের মৌসুমে পানি নেই। কেউ সেচ দিয়ে চাষ করছে, আবার কেউ জমি ফেলে রেখেছে।’

অন্য এক কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আগে বন্যা হলে জমিতে পলি পড়ত, জমি উর্বর হতো। এবার সেটাও হচ্ছে না। আবার হঠাৎ বন্যা এলে সব শেষ হয়ে যাবে।’

বিশেষজ্ঞ মত

পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘মৌসুমি বন্যার বদলে আকস্মিক বন্যা হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। তবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব কিনা, আরও গবেষণা দরকার।’

কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যা সহনশীল ও লেট ভ্যারাইটি ধান উদ্ভাবন করে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।’

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা ড. মো. মামুনুর রহমান বলেন, ‘কৃষকদের বিকল্প প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন উঁচু জমিতে বীজতলা, অঙ্কুরিত ছিটা ধান বা দোগাছি রোপণ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা একমত—সময়ের বন্যা না হলে যেমন ফসলের ক্ষতি হয়, তেমনি বিলম্বিত বন্যাও কৃষির জন্য ভয়াবহ। জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব মোকাবিলায় সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও কৃষি গবেষণার বিকল্প নেই।


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন