শিমের রাজ্যে ভাইরাসের হানা: কৃষকের দিশাহারা দিন ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা

বাংলাদেশের শীতকালীন সবজি চাষের মানচিত্রে পাবনার ঈশ্বরদী বিশেষভাবে পরিচিত ‘শিমের রাজ্য’ হিসেবে। প্রায় তিন দশক ধরে এখানে শিমের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। এক যুগ আগে কৃষকেরা শুরু করেন আগাম শিম চাষ, যা এখন স্থানীয় অর্থনীতির বড় ভিত্তি।

প্রতি বছর এই শিম কৃষকদের ভাগ্য বদলে দিলেও এবারের দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন। অতিবৃষ্টি ও ভাইরাস আক্রমণে কৃষকের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে।

শিমের মাঠে অঘটন

ঈশ্বরদীর কৃষকেরা আষাঢ় মাস থেকে শিমের আবাদ শুরু করেন। এ বছর শুরুতেই টানা বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে গাছের গোড়া। এ সুযোগে হলুদ মোজাইক ভাইরাস, ছত্রাক ও সাদা মাছি–জাব পোকার আক্রমণ শিমক্ষেতকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

ফলন কমে আসছে ভয়াবহভাবে—

  • অন্যান্য বছর প্রতি বিঘায় প্রতিদিন যেখানে ৩০–৪০ কেজি শিম তুলতেন,
  • এবার তুলতে পারছেন মাত্র ৮–১০ কেজি।

মাঠ থেকে কৃষকের কান্না

  • বাঘহাছলার কৃষক মফিজ উদ্দিন শেখের অভিযোগ— “অতিবৃষ্টিতে শিমের ডগা কুঁকড়ে যাচ্ছে, পাতা শুকিয়ে পড়ছে। কীটনাশক দিলেও কাজ হচ্ছে না।”
  • রামনাথপুর গ্রামের রায়হান আলী প্রতিদিন স্প্রে করছেন, কিন্তু ফল মিলছে সামান্য।
  • হাবিবুর রহমান শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন— “এ রোগে ফলন এত কমবে যে শিম বিক্রি করাই কঠিন হয়ে যাবে।”
  • সূর্যবান নামের এক কৃষক প্রতিদিন ভাইরাসে আক্রান্ত লতা, পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। এতে শ্রম ও খরচ বেড়ে যাচ্ছে, ফলন কমছে।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে সমস্যা

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রুমানা পারভীন মনে করেন, কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সাদা মাছি ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করা সম্ভব। তবে ভাইরাস আক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলা জরুরি।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মমিন আশার সুরে বলেন, “শিম হারভেস্ট শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টি কমে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।”

বিশ্লেষণ: কেন এই বিপর্যয়?

১. অতিরিক্ত বৃষ্টি ও জলবায়ু পরিবর্তন
– মৌসুমি আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তনে কৃষি ঝুঁকিতে।
২. একক ফসল নির্ভরতা
– ঈশ্বরদীর কৃষকেরা শিমের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ঝুঁকি আরও বেশি।
৩. ভাইরাস ও কীট দমন কৌশলের সীমাবদ্ধতা
– কৃষকেরা এখনও ডিলারদের দেওয়া কীটনাশকেই ভরসা করছেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।
৪. খরচ ও লাভের সমীকরণ
– সার, কীটনাশক, শ্রমের খরচ বাড়লেও ফলন কমছে, ফলে কৃষক লোকসানে পড়বেন।

কৃষকের দিশাহারা ভবিষ্যৎ
  • কম ফলনে কৃষকেরা লোকসান গুনবেন।
  • স্থানীয় বাজারে আগাম শিমের সরবরাহ হ্রাস পাবে।
  • ভোক্তা পর্যায়ে শিমের দাম বাড়বে।
  • কৃষকের মনে প্রশ্ন— “আগামী মৌসুমেও কি এমনই বিপর্যয় হবে?”
করণীয় ও সুপারিশ
  • রোগ প্রতিরোধী শিমের জাত উদ্ভাবন ও কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
  • কৃষকদের প্রশিক্ষণ— কীভাবে ভাইরাস সংক্রমণ শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  • সরকারি পর্যায়ে মনিটরিং ও সাপোর্ট বৃদ্ধি।
  • বাজারভিত্তিক ঝুঁকি কমাতে ফসলের বহুমুখীকরণে উৎসাহ।

ঈশ্বরদীর শিম শুধু একটি সবজি নয়, হাজারো কৃষক পরিবারের জীবিকার উৎস। ভাইরাসের হানায় যখন কৃষকের হাসি ম্লান, তখন দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। নাহলে “শিমের রাজ্য” খ্যাতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন