একদিনে ৩৫০ সোনালিকা ট্রাক্টর হস্তান্তর করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের পথে এসিআই মোটরস

বিশেষ প্রতিনিধি, দিনাজপুর

বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের পাশে বাণিজ্য মেলা মাঠে আয়োজিত এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে এসিআই মটরস একদিনে ৩৫০ জন কৃষক ও উদ্যোক্তার হাতে তুলে দিয়েছে সোনালিকা ট্রাক্টর।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান এসিআই মটরস জানিয়েছে, এক দিনে এতগুলো ট্রাক্টর হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে তারা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অর্জনের উদ্যোগ নিয়েছে। দুপুর একটার দিকে কৃষক ও উদ্যোক্তারা নিজ নিজ ট্রাক্টরে বসে এসিআই মটরসের পতাকা নাড়িয়ে এই উদযাপনে অংশ নেন।

কৃষকের চোখে নতুন স্বপ্ন

অনুষ্ঠানে ট্রাক্টর নিতে আসা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের তরুণ রনি ইসলাম কালীগঞ্জ টেকনিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বাবা হযরত আলীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এই বিশ্ব রেকর্ড গড়ার ইভেন্টের অংশ হয়েছেন।

উচ্ছ্বাসভরে রনি বলেন, “এই ট্রাক্টর দিয়ে বাবার সঙ্গে নতুন করে মাঠে সোনালী ফসল ফলানোর স্বপ্ন দেখছি।”

তার বাবা হযরত আলী যোগ করেন, “এই ট্রাক্টর দিয়ে নিজের ১২ বিঘা জমির পাশাপাশি আশপাশের জমিও চাষ করা যাবে। এখন আর আগের মতো হালচাষ হয় না, সময় বদলেছে। আধুনিক জীবনে টিকে থাকতে গেলে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। এটিই আমাদের ভবিষ্যৎ।”

আঠারো বছরের সাফল্য ও বাজারের শীর্ষস্থান

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোনালিকার সঙ্গে টানা ১৮ বছরের অংশীদারিত্বে দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এসিআই মটরস লিমিটেড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দেশের ট্রাক্টর বাজারে ৫০ শতাংশেরও বেশি মার্কেট শেয়ার ধরে রেখেছে। দিনাজপুরের এই বিশেষ আয়োজনের লক্ষ্য ছিল এই সাফল্য উদ্‌যাপন এবং কৃষিতে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এসিআই মটরসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুব্রত রঞ্জন দাস। প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাক্টরস লিমিটেডের ডিরেক্টর ও সিইও গৌরব সাক্সেনা।

কৃষকদের আস্থার কারণ: সোনালিকা

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কৃষকরা জানিয়েছেন কেন সোনালিকা ট্রাক্টর তাদের পছন্দের শীর্ষে।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরের কৃষক মো. দোলোয়ার হোসেন ২০১৫ সাল থেকে ট্রাক্টর ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, “কোম্পানির সুবিধা শুনে সোনালিকা ট্রাক্টর কিনি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, এর পারফরম্যান্স সত্যিই ভালো।”

ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া উপজেলার কৃষক আবুল খালেক জানান, তিনি সাত বছর ধরে ট্রাক্টর ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, “সাধারণত বছরে দুই মৌসুমে চার মাস চাষ করা হয়। অন্য সময় ট্রাক্টরে আলাদা বডি লাগিয়ে ভুট্টা, ধান, মাটি ও ইট পরিবহন করি। এই ট্রাক্টরের ইঞ্জিন ভালো, তাই চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সহজ কিস্তিতে কেনা যায়, এজন্যই এটি বিশ্ব রেকর্ড গড়ছে।”

কর্মকর্তারা জানান, একটি সোনালিকা ট্রাক্টর দিয়ে দিনে ১২ থেকে ১৫ একর জমি চাষ করা যায়, যেখানে তেল লাগে মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৫ লিটার।

বিশেষত্ব ও ডিজিটাল সেবা

সোনালিকা ব্যবহারকারী ও এসিআই মটরস কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে এটি বাংলাদেশের নম্বর ওয়ান ট্রাক্টর ব্র্যান্ড। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

  • এটি ফুয়েল সাশ্রয়ী।
  • বিক্রির পর কাস্টমারদের দ্রুত সার্ভিস দেওয়া হয় (ছয় ঘণ্টার মধ্যেই স্পট সার্ভিস)।
  • অন্য ট্রাক্টরের তুলনায় এর রিসেল ভ্যালু বেশি।
  • পার্টস মানসম্মত ও সহজলভ্য।

এছাড়াও, চাষি ও উদ্যোক্তাদের জন্য কোম্পানি তৈরি করেছে ‘সোনালিকা সমৃদ্ধি’ অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সরাসরি সমস্যার রিপোর্ট করতে পারেন এবং টেকনিশিয়ানরা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান দেন। এসিআই মটরসের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. শামীম হোসেন জানান, এই সার্ভিস পাঁচ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে দেওয়া হয়।

কর্মকর্তাদের বক্তব্য

মো. আসিফ উদ্দীন (চিফ বিজনেস অফিসার, এসিআই মটরস): “এক মাঠে এক দিনে এত ট্রাক্টর হস্তান্তর শুধু ব্যবসায়িক অর্জন নয়, এটি কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিপ্লবের প্রতীক। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে কৃষকদের ঘাম, পরিশ্রম ও ভালোবাসা। এখন সময় এসেছে সেই শ্রমকে প্রযুক্তির শক্তিতে রূপান্তরিত করার।”

গৌরব সাক্সেনা (সিইও, ইন্টারন্যাশনাল ট্রাক্টরস লিমিটেড): “এসিআইয়ের সঙ্গে ব্যবসার প্রথম বছরে বাংলাদেশে ৩০০ সোনালিকা ট্রাক্টর বিক্রি হয়েছিল। আজ আমরা এক দিনে ৩৫০ ট্রাক্টর হস্তান্তর করছি। এটি ক্রেতাদের সন্তুষ্টিরই প্রতিফলন। এসিআই টিমের প্রতি শুভ কামনা।”

সুব্রত রঞ্জন দাস (ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এসিআই মটরস): “দেশের নাম ঘুরে বেড়ায় না, ঘুরে বেড়ায় দেশের মানুষ ও তাদের অর্জন। আমরা কৃষির যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং করতে চাই; যাতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের কৃষকরা বিশ্বমানের। আজ যারা ট্রাক্টর নিয়েছেন, তারা বিশ্বের একটি বড় একটি ইভেন্টের অংশ হয়ে গেলেন।”

গিনেস রেকর্ডের পথে

অনুষ্ঠানে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস লিমিটেডের বিচারক কার্ল স্যাভিলের একটি ভিডিও বার্তা তুলে ধরা হয়। তিনি তার বার্তায় বলেন:

“আজকের এই উদ্যোগ বিশ্বের সর্বাধিক ট্রাক্টর ডেলিভারির রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। আপনারা যদি ইভেন্টে উপস্থিত থাকেন, উপভোগ করুন; আর অংশগ্রহণকারী হলে অবশ্যই সমস্ত নির্দেশিকা মেনে চলুন, নইলে রেকর্ড বাতিল হয়ে যেতে পারে।”


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন