ল্যাবেই বন্দি উদ্ভাবন: মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ৫৮ জাত, প্রয়োগ নেই মাঠে

বিশেষ প্রতিনিধি, বগুড়া:

বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবনের তালিকায় আছে ২৭টি প্রজাতির ৫৮টি নতুন জাত এবং ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি। তবে কর্মকর্তাদের এসব দাবির কোনো সুফল পাচ্ছে না সাধারণ কৃষক। মাঠপর্যায়েও নেই উদ্ভাবনের তেমন কোনো প্রতিফলন। ফলে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীন এই প্রতিষ্ঠানটি তার মূল উদ্দেশ্য পূরণে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত বেশিরভাগ জাতের নামই জানেন না কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও দুই-একটি মসলা ছাড়া অন্য জাতগুলো চাষের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারছেন না।

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, বীজ সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি গত দুই বছরে (২০২৪ সাল সহ) এই কেন্দ্র থেকে কোনো বীজই কেনেনি।

বিপুল ঘাটতি, তবুও মাঠে নেই গবেষণা

গবেষকরাই জানাচ্ছেন, দেশে মসলার চাহিদা ও আমদানির ঘাটতি ব্যাপক।

  • বার্ষিক চাহিদা: ৫৮.৫০ লাখ মেট্রিক টন
  • আমদানি: ৪৪.৯৬ লাখ মেট্রিক টন
  • ঘাটতি: ১৩.৫৪ লাখ মেট্রিক টন
  • আমদানি ব্যয়: বছরে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা।

এই বিশাল ঘাটতি পূরণে গবেষণা কেন্দ্রটির উদ্ভাবনগুলো মাঠে গড়ানোর কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

মাঠের চিত্র: কৃষকরা চেনেন না নতুন জাত

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার দুজন আদা চাষি জানান, “সরকারি বা গবেষণার কোনো জাত আমরা পাই না, নামও জানি না। নিজেরাই বীজ রাখি অথবা হাট থেকে কিনি। তবে এখন বস্তায় আদা চাষ হচ্ছে বলে শুনেছি। এখনো কৃষি বিভাগ থেকে এই বিষয়টি আমাদের দেখানো হয়নি।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, “মসলা গবেষণা কেন্দ্র আমাদের কাছে জাত পাঠায় না, তাই কোনো প্রশিক্ষণ বা প্রদর্শনীও হয় না। কার্যক্রম না থাকলে কৃষকের কাছে যাওয়া যায় না।”

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শাসসুদ্দীন ফিরোজ গণমাধ্যমকে জানান, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা কৃষককে নিয়ে মাঠে কাজ করি। তবে এসব জাত ছড়িয়ে পড়ার সরকারি কোনো ট্র্যাকিং বা বাস্তব দৃষ্টান্ত নেই।”

সমন্বয়হীনতা: বীজ কিনছে না বিএডিসি

উদ্ভাবিত জাত মাঠে ছড়িয়ে দেওয়ার মূল দায়িত্ব বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। কিন্তু বিএডিসির (বীজ) উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কমল কান্তি বর্মন গণমাধ্যমকে বলেন, “বিগত ২০২৪ সালে তারা বগুড়া থেকে কোনো মসলা বীজ ক্রয় করেনি। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।”

কাগজেই সীমাবদ্ধ সেবা, বাজেট সংকটের অজুহাত

কেন্দ্রের দাপ্তরিক নথিতে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য নানা সেবার কথা বলা আছে। এর মধ্যে রয়েছে— প্রজনন বীজ বিতরণ, লিফলেটের মাধ্যমে জাত পরিচিতি, মাঠ দিবস, কৃষক প্রশিক্ষণ এবং সরেজমিনে কৃষকের সমস্যা সমাধান।

তবে বাস্তবে এসব কার্যক্রমের কোনো বড় উদাহরণ মাঠে মেলেনি। ৯৫ শতাংশ কৃষক জানান, তারা কোনোদিনই মসলা গবেষণা কেন্দ্রের কারো মুখোমুখি হননি।

এই অচলাবস্থার কারণ হিসেবে বাজেট স্বল্পতাকে দায়ী করছেন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, “গবেষণার বাইরে আমাদের বাজেট নেই, এ কারণে সম্প্রসারণ কাজ করা যায় না। এমনকি জাত বিস্তারের জন্য নিজস্ব প্লট বা আউটরিচ কার্যক্রমও নেই।”

তবে তিনি নিজেকে ‘বস্তায় আদা চাষ’-এর উদ্ভাবক দাবি করে বলেন, “এটি আধুনিক ও সময়োপযোগী পদ্ধতি। এখন এই পদ্ধতির কারণে কৃষক উপকার পাচ্ছেন।”

অপ্রয়োজনীয় গবেষণায় বাজেট ব্যয়?

কেন্দ্রের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বাজেট প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠেছে, এই বাজেটের অর্থ এমন ফসলের গবেষণায়ও ব্যয় হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মাটিতে সফল নয়।

জানা যায়, কেন্দ্রটি যুগ যুগ ধরে এলাচ, মৌরি ও কালো এলাচের মতো ফসল নিয়ে কাজ করছে। অথচ কর্মকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করেন, মাটির গুণাগুণের কারণে সাদা ও কালো এলাচের জাত উদ্ভাবন এখানে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় জেনেও কেন বছরের পর বছর এই খাতে গবেষণা বাজেট খরচ হচ্ছে, সে প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি।

কৃষকের আক্ষেপ ও বিশেষজ্ঞের মত

প্রতিবছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে আদা, রসুন, পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হলেও কৃষকরা এখনও ২০-৩০ বছর আগের পুরোনো জাতেই চাষ করছেন।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) এর বগুড়ার সম্পাদক কেজিএম ফারুক এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন:”গবেষণাগারে জাত উদ্ভাবন হচ্ছে, কিন্তু কৃষকের মাঠে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিস্তারের পরিকল্পনা নেই, বাজেট নেই, পর্যবেক্ষণ নেই। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রযুক্তি রয়েছে কেবল রিপোর্ট আর কাগজে। ফলে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি, কার্যকারিতা ও কৃষকভিত্তিক বাস্তবতা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে।”


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন