দেশে ২০৭০ সালের মধ্যে হারিয়ে যাবে শীত, বাড়বে অসহনীয় তাপপ্রবাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা:

গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো না গেলে আগামী কয়েক দশকে বাংলাদেশের জলবায়ু নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। এর প্রভাবে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশ থেকে শীতকাল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে শতাব্দীর শেষে দেশের তাপমাত্রা বাড়তে পারে সাড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।

বুধবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ুর রিপোর্ট-২০২৫’-এ এমন আশঙ্কার চিত্র উঠে এসেছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও শীতের বিদায়ঘণ্টা গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৪১ থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের গড় তাপমাত্রা আরও ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। আর এই শতাব্দীর শেষে তা দেড় থেকে সাড়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তাপমাত্রা বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়বে শীতকালের ওপর। উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামান্য কিছু শৈত্যপ্রবাহ থাকলেও উপকূলীয় এলাকা থেকে শীত ক্রমেই সরে যাবে। শতাব্দীর শেষে শীতকাল প্রায় হারিয়েই যাবে। ওই সময় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বড়জোর এক-দুই দিন মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিতে পারে।

ঢাকার জন্য দুঃসংবাদ রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি আরও কঠিন হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে ঢাকাবাসীকে বছরে অন্তত দুটি তীব্র তাপপ্রবাহের বা হিটওয়েভের মুখে পড়তে হবে—একটি বর্ষার আগে, আরেকটি বর্ষার পরে (অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে)। দিনের তাপমাত্রা সাড়ে ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়াকে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলে ২০৭০ সালের মধ্যে বর্ষার আগের ২০ দিন পর্যন্ত তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে, যা আগের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি।

অতিবৃষ্টি ও বন্যার ঝুঁকি বৃষ্টিপাতের ধরনেও বড় পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে গবেষণাটি।

  • ২০৭০ সালের মধ্যে বর্ষার বৃষ্টি গড়ে ১১৮ মিলিমিটার বাড়তে পারে।
  • ২১০০ সালে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ২৫৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
  • সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, যা অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

তলিয়ে যাবে উপকূল, বাস্তুচ্যুত হবে ১০ লাখ মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বে যেখানে বছরে গড়ে ২ দশমিক ১ মিলিমিটার পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের উপকূলে তা ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

  • শতাব্দীর শেষে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৮ শতাংশ এলাকা স্থায়ীভাবে পানির নিচে চলে যেতে পারে।
  • সুন্দরবনের ২৩ শতাংশ অংশ পানিবন্দি হয়ে পড়তে পারে।
  • ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কৃষি ও জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের উৎপাদন কমবে, গবাদিপশুর রোগবালাই বাড়বে এবং লবণাক্ততার কারণে মিঠাপানির উৎস সংকুচিত হবে। এছাড়া ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত রোগ বাড়বে। অতিরিক্ত গরমে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমবে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন হঠাৎ থেমে যাবে না। তাই প্রস্তুতিও দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি উপকূলে সুরক্ষা অবকাঠামো জোরদার, বাঁধ নির্মাণ, আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো এবং আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে।”

নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধু পরিবেশের কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়। এটি কৃষি, জনস্বাস্থ্য, নগরায়ণ, জ্বালানি—সব খাতে প্রভাব ফেলছে। তাই মোকাবিলায় সব খাতের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।”

উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট যৌথভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করছে। এটি তাদের তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিবেদন।


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন