নিজস্ব প্রতিবেদক:
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও যত্রতত্র শিল্পায়নের ফলে দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমছে কৃষিজমি। এই সংকট মোকাবিলায় কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। এখন থেকে অনুমোদন ছাড়া কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক আবাসন, রিসোর্ট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কারখানা নির্মাণ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এমন বিধান রেখে ‘ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর গেজেট আকারে এটি জারি হবে। তবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি—এই তিন পার্বত্য জেলা এই অধ্যাদেশের আওতার বাইরে থাকবে।
কেন এই অধ্যাদেশ?
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন হচ্ছে এবং কৃষিজমি কমছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ভূমির প্রকৃতি অনুযায়ী জোনভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যেই এই অধ্যাদেশ করা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষিজমি এভাবে কমতে থাকলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। তাই কৃষিজমি, পাহাড়, বন ও জলাশয়ের সুরক্ষায় এই কঠোর আইন করা হচ্ছে।”
১৮ শ্রেণিতে ভাগ হবে দেশের ভূমি নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘ভূমি ব্যবহার জোনিং ম্যাপ’ তৈরি করবে। ভূমিকে মোট ১৮টি শ্রেণিতে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে—কৃষি অঞ্চল, বিশেষ কৃষি অঞ্চল, মৎস্য চাষ অঞ্চল, নদী-খাল, জলাশয়, শিল্প অঞ্চল, বনাঞ্চল, পাহাড়-টিলা ইত্যাদি।
কৃষিজমি সুরক্ষায় কঠোর বিধিনিষেধ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে:
- বহু ফসলি জমি: দুই, তিন বা ততোধিক ফসল হয়—এমন জমি অকৃষিকাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যাবে না। তবে জাতীয় প্রয়োজনে (যেমন খনিজ সম্পদ আহরণ) সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমি ব্যবহারের সুযোগ থাকতে পারে।
- টপ সয়েল বা মাটির ব্যবহার: ইটভাটায় ব্যবহারের জন্য কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) বা পাহাড়-টিলার মাটি কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
- জলাধার ও পাহাড়: কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে জলাধার ভরাট বা পাহাড় কাটা যাবে না।
- বিশেষ কৃষি অঞ্চল: সরকার খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ‘বিশেষ কৃষি অঞ্চল’ ঘোষণা করবে, যা কোনোভাবেই অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
অপরাধ ও শাস্তির বিধান
আইন অমান্যকারীদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে:
- শ্রেণি পরিবর্তন: অনুমোদন ছাড়া ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা।
- অকৃষিকাজে ব্যবহার: অনুমোদনহীনভাবে কৃষিজমি অকৃষিকাজে ব্যবহার করলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা।
- স্থাপনা নির্মাণ: কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক আবাসন, রিসোর্ট বা কারখানা করলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৪ লাখ টাকা জরিমানা।
- ইটভাটার মাটি: কৃষিজমির টপ সয়েল বা পাহাড়ের মাটি ইটভাটায় ব্যবহার করলে ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৪ লাখ টাকা জরিমানা।
- বিশেষ কৃষি অঞ্চলের ক্ষতি: বিশেষ কৃষি অঞ্চলের ক্ষতি করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া অপরাধের সঙ্গে জড়িত যন্ত্রপাতি জব্দ এবং অবৈধ স্থাপনা নিজ খরচে অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতাও কর্তৃপক্ষের থাকবে।
জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব আইন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। তাঁরা নিজ নিজ জেলায় কৃষিভূমি, জলাধার ও পাহাড়ের তালিকা প্রস্তুত করবেন এবং নিয়মিত মনিটরিং করবেন। কোনো ইটভাটা লাইসেন্স পাওয়ার আগে মাটির উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারনামা দিতে হবে।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.