অতিরিক্ত রাসায়নিক ও আগ্রাসী চাষপদ্ধতির কারণে তামাক ধ্বংস করছে জমির স্বাস্থ্য, বাধা সৃষ্টি করছে পরিবেশবান্ধব কৃষির পথে
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশে আবাদযোগ্য জমির টেকসই ব্যবস্থাপনা ও মাটির উর্বরতা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সম্প্রতি দেশে তামাক চাষের অস্বাভাবিক বিস্তার এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তামাক চাষ শুধু মাটির গঠন ও উর্বরতা নষ্ট করছে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের ওপরও ফেলছে গভীর নেতিবাচক প্রভাব।
বিশ্বজুড়ে যেখানে তামাক চাষ হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এটি উন্নয়নশীল অঞ্চলে উচ্চ মুনাফার লোভে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৯০% কৃষক এখন তামাক চাষে নির্ভরশীল, যা খাদ্য উৎপাদনের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
মাটির ক্ষতি: উর্বরতা কমে যাচ্ছে, জমি হয়ে পড়ছে অনুপযোগী
তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও পানি ব্যবহারের ফলে জমি হারাচ্ছে স্বাভাবিক গঠন ও উৎপাদনক্ষমতা। ইউরিয়া, টিএসপি এবং ৪৭ প্রকার কীটনাশকের অতিমাত্রায় প্রয়োগে মাটির অণুজীব মরে যাচ্ছে, জমি হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিকভাবে মৃতপ্রায়। তামাক কাটার পর অনেক ক্ষেত্রে অন্য ফসল ফলানো যাচ্ছে না।
একচেটিয়া মৌসুম দখল, স্থানীয় বীজ হারানোর শঙ্কা
তামাক চাষ রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২ তিন মৌসুম জুড়ে জমি দখল করে রাখে। ফলে ধান, ডাল, সরিষা, সবজি, পাটের মতো খাদ্য ও অর্থকরী ফসলের আবাদ কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ফসল ও বীজের বৈচিত্র্য।
কোম্পানির কৌশল: প্রলোভন, অগ্রিম ও নিয়ন্ত্রিত বাজার
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো সহ একাধিক কোম্পানি অগ্রিম অর্থ, বিনামূল্যে বীজ-সার দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে। পরে সেই তামাক আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রিত দামে কিনে নিচ্ছে, যেখানে কৃষকের সত্যিকারের লাভ সীমিত।
পরিসংখ্যান বলছে, বাড়ছে ঝুঁকি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী,
- ২০০১ সালে তামাক চাষ হতো ৭৩,৮৭০ একর জমিতে।
- ২০১১-১২ মৌসুমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,২৬,০০০ একরে।
- এই জমির বড় অংশ পূর্বে ছিল খাদ্য ফসল ও সবজি চাষের আওতায়।
গবেষণা ও বিশ্লেষণ
উবিনীগ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক হেক্টর জমিতে বছরে গড়ে ১৬ বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। অতিরিক্ত বিষাক্ত উপাদান জমির স্বাস্থ্য ধ্বংস করে এবং পানির স্তরেও বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম. এ. সোবাহান বলেন, “তামাক হচ্ছে বহিরাগত আগ্রাসী ফসল। এটি শুধু মাটি নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে।”
সতর্ক বার্তা ও সমাধান
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএস জুবায়ের বলেন, “তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন বিকল্প লাভজনক ফসলের উৎসাহ ও বাজার নিশ্চিত করা।”
সরকারের পক্ষ থেকেও সচেতনতামূলক সভা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে তামাক চাষ থেকে সরে আসতে।
তামাক চাষ এখন আর শুধুমাত্র একটি কৃষি উৎপাদন নয়; এটি পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি মৌলিক হুমকি।
বাংলাদেশ যদি টেকসই কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে চায়, তবে এখনই সার্বিক নীতিগত পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা বাড়িয়ে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যাবশ্যক।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.