দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগান্তকারী সাফল্য, কোল্ড-চেইন ছাড়াই কার্যকর।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শশি আহমেদ মুরগির ভাইরাসজনিত রানীক্ষেত রোগ (নিউক্যাসল ডিজিজ) প্রতিরোধে কার্যকর একটি তাপসহনশীল (থার্মোস্টেবল) ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন।
এই উদ্ভাবন ইতোমধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরীক্ষায় সফলতা পেয়েছে।
গবেষণা কার্যক্রমটি রাবির কৃষি অনুষদের আই-টু এনডি ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত হয়। এতে অধ্যাপক শশি আহমেদের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থীও অংশগ্রহণ করেন।
রানীক্ষেত রোগ: প্রাণঘাতী ভাইরাস মুরগির জন্য
নিউক্যাসল ডিজিজ বা রানীক্ষেত একটি সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ, যা মুরগি, কবুতর, টার্কি ও অন্যান্য পাখিকে আক্রান্ত করে। এর উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- সবুজ রঙের পায়খানা।
- খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া।
- পাখা ঝুলে যাওয়া।
- ঘাড় বাঁকা করে মাথা ঘোরানো।
- ঝিম ধরে বসে থাকা।
এই ভাইরাস মুরগির দেহে ঢুকে ১৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং পরবর্তীতে হঠাৎ করে রোগ প্রকাশ পায়। এটি খাবার, পানি, বাতাস ও মানুষের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। আক্রান্ত খামারে প্রায় সব মুরগির মৃত্যু হতে পারে।
উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন: তাপ সহনশীল, সহজে সংরক্ষণযোগ্য
বর্তমানে বাজারে থাকা রানীক্ষেত ভ্যাকসিনগুলো ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কোল্ড-চেইনে সংরক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে প্রত্যন্ত এলাকায় সেগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা কঠিন।
অন্যদিকে, শশি আহমেদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সাত দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। তাই দেশের বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ও প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এটি সহজে প্রয়োগযোগ্য।
অধ্যাপক শশি আহমেদ বলেন, “এই ভ্যাকসিন খাবারের সঙ্গে বা পানিতে মিশিয়ে মুরগিকে খাওয়ানো যাবে, প্রয়োগ পদ্ধতি সহজ।”
তিন বছরের গবেষণা, ১৪ কোটি টাকার প্রকল্প
২০২৪ সালের শুরুতে রাজশাহী ও নাটোর জেলার ছয়টি উপজেলায় ৫ হাজার পরিবারের মধ্যে রানীক্ষেত নিয়ন্ত্রণে গবেষণা শুরু হয়। ২০২৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলা এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৪.৫ কোটি টাকা।
অর্থায়ন করছে:
- বাংলাদেশ সরকার (শিক্ষা মন্ত্রণালয়)।
- হেইফার ইন্টারন্যাশনাল (আমেরিকা)।
- কায়িমা ফাউন্ডেশন (অস্ট্রেলিয়া)।
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মাঠপর্যায়ের গবেষণা শুরু, কার্যকারিতা যাচাই হচ্ছে
গত ৩১ জুলাই থেকে মাঠপর্যায়ে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এটি আশাব্যঞ্জক ফল দিচ্ছে। দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ ফলাফল পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক শশি আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, “এই মডেল সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশি মুরগির উৎপাদন বাড়বে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন সম্ভব হবে।”
প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে এই ভ্যাকসিনটি সরকারিভাবে উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে।
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে নতুন দিগন্ত
এই ভ্যাকসিন সফলভাবে প্রয়োগ করা গেলে বাংলাদেশের পোল্ট্রি খাত, দেশি মুরগির উৎপাদন এবং প্রান্তিক খামারিদের জীবনমান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে তাপ সহনশীলতার কারণে কোল্ড-চেইন নির্ভরতা কমবে, যা গ্রামাঞ্চলে এটি আরও কার্যকর করে তুলবে।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.