ফজলুর রহমান
জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে। শুধু পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, সরাসরি শিক্ষার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন।
বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙন, মহামারি, পাহাড় ধস, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ইত্যাদি কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকার হার বেড়ে যাচ্ছে ক্রমেই।
জলবায়ু পরিবর্তন বলতে তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার ধরনে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনকে বুঝায়। কিন্তু মানুষের কারণেও জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে তা অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ।
বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, তেল এবং গ্যাস পোড়ানো যা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ায়।
এটি বিশ্বকে উষ্ণায়নের দিকে পরিচালিত করে তীব্র খরা, পানির অভাব, মারাত্মক দাবানল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, মেরুর বরফ গলে যাওয়া, বিপর্যয়কর ঝড় এবং ক্ষয়প্রাপ্ত জীববৈচিত্র্যের মতো পরিবেশগত প্রভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
গত জানুয়ারিতে জাতিসংঘের শিশু তহবিল- ইউনিসেফের এক বিশ্লেষণে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের হিসেবে গত বছর ১২ মাসের মধ্যে জলবায়ুজনিত সংকটের কারণে সিলেট অঞ্চলে শিশুরা সব মিলিয়ে আট সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
২০২৪ সালে চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির কারণে বাংলাদেশের তিন কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
প্রথমবারের মতো এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। এতে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির কারণে দফায় দফায় স্কুল বন্ধ দিতে হয়েছে।
সারা বিশ্বে ২০২৪ সালে তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যা ও খরার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে ৭৭টি দেশের অন্তত ২৪ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল দক্ষিণ এশিয়া।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের এপ্রিল ও মে মাসে দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ শিশুদের পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) ও হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করে, ফলে সারা দেশে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুলে ছুটি দিতে বাধ্য হয়।
মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বেশ কিছু জেলায় শিশুদের স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এরপর জুনে হয় তীব্র বন্যা, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশুদের শিক্ষার ওপর।
বন্যায় সারা দেশে প্রায় ১ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ৭০ লাখ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘চরম আবহাওয়াজতি ঘটনাবলির তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা বারবার আঘাত হানার প্রবণতাও বেড়েছে। জলবায়ু সংকট এটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এগুলোর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষার ওপর এবং শিশুরা তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চরম তাপমাত্রা ও অন্যান্য জলবায়ুজনিত সংকট শুধু শিশুদের স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমই ব্যাহত করে না, বরং এর কারণে শিশুদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বড় সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকলে শিশুদের-বিশেষ করে কন্যাশিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সুযোগ বেড়ে যায়, বেড়ে যায় পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে বাল্যবিবাহের ঝুঁকির হার।’
ইউনিসেফের চিলড্রেন’স ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক) অনুযায়ী, জলবায়ু ও পরিবেশগত সংকটের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিশুরা।
এসব নিয়মিত দুর্যোগের কারণে দেশে ‘শিখন দারিদ্র্য’ (১০ বছর বয়সেও সহজ কোনো লেখা পড়তে না পারলে অথবা পড়ে বুঝতে না পারলে শিক্ষার্থীর সেই অবস্থাকে শিখন দারিদ্র্য বলে) দিন দিন আরও ব্যাপক হয়ে উঠছে।
দেখা গেছে স্কুলগামী শিশুদের প্রতি দুজনে একজন তার ক্লাস অনুযায়ী যতটুকু পড়তে পারার কথা, তা পারছে না, আবার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরও দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী মৌলিক গণনা পারে না।
এসব প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষার জন্য সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষা খাতকে জলবায়ু সহনশীল করে তুলতে অর্থায়ন ত্বরান্বিত করা, যাতে জলবায়ুর অভিঘাত সামলে নিতে সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পরীক্ষিত, টেকসই ও কার্যকর সমাধানে বিনিয়োগ করা যায়।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে হবে সব শিশুর জন্য নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। দ্বিতীয়ত, জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনাগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
এর আওতায় ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন ৩.০ এবং ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা) বাস্তবায়ন করতে হবে।
সেই সঙ্গে শিশুকেন্দ্রিক জরুরি সামাজিক সেবাগুলো জোরদারকরণ যেমন শিক্ষা, আরও বেশি জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ও দুর্যোগ সহনশীল হয়ে গড়ে ওঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
তৃতীয়ত, জলবায়ুকেন্দ্রিক নীতি প্রণয়নপ্রক্রিয়ার সব পর্যায়ে শিশু ও তরুণদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক দেখিয়েছে ২০২২ সাল থেকে বিরুপ আবহাওয়ার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি শিক্ষার্থীর। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাবে স্বল্প আয়ের দেশের শিশুরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
এসব দেশে বিদ্যালয় বন্ধ ছিল গড়ে ১৮ দিন করে। বাংলাদেশেও গত এপ্রিলে তাপপ্রবাহে বেশ কয়েকটি জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১০ বছর বয়সী একজন শিশু ১০৭০ সালের সমবয়সী শিশুদের তুলনায় বন্যার সম্মুখীন হয়েছে প্রায় তিন গুণ বেশি, পাঁচ গুণ বেশি খরা ও ৩৬ গুণ বেশি তাপপ্রবাহের সম্মুখীন।
তাই স্কুল খোলা থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক শিশু অনুপস্থিত থাকছে। শিক্ষার শক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে।
চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ঘটনা শিক্ষা পরিষেবা ব্যাহত করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্থানান্তরিত করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই হার অনেকগুণে বৃদ্ধি পেতে পারে।
তাই আমাদের আর একদম বসে থাকা চলবে না। যেভাবেই হোক, জলবায়ু সংকটকে প্রশমিত করতে চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি স্বল্প খরচের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য অভিযোজন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
টেকসই ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় অগ্রসর হতে পারলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের রাখা যাবে, শিক্ষার ব্যাঘাতও রুখে দেয়া যাবে।
লেখক: উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.