সাদ কাশেম
জলবায়ু পরিবর্তন এমন এক বিষয়, শুনলেই সাধারণত আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অসময়ে বন্যা, তীব্র জলোচ্ছ্বাস, খরা, বাসযোগ্যহীন লোকালয় ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কাবু মানব জাতির চিত্র ফুটে ওঠে।
মনে হয়, এক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মানুষের এই দুর্দশা। বস্তুত এমন চিত্র তুলে ধরা হয়ে থাকে, যেন জলবায়ু পরিবর্তন এক বিরাট দানবীয় বিষয়।
পৃথিবীর ‘সাজানো গোছানো পরিবেশ’ তছনছ করে দিচ্ছে। বৈশ্বিক এই ধারণার সঙ্গে বঙ্গীয় ব-দ্বীপে অবস্থিত আমাদের প্রিয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশও এই ধারণায় বিস্ময়করভাবে প্রভাবিত। প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে এই ধারণার দার্শনিক রূপরেখা কী?
বৈশ্বিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মূলধারায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ শব্দটি চার দশক ধরে সাধারণত বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বৈজ্ঞানিক অনুমান ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন এটা ব্যবহারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর সাধারণ ভাষ্য অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের অবনতির মূল হোতা বায়ুদূষণের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে।
এই বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। অস্বীকারের অবকাশ নেই, পৃথিবীর ভূভিত্তিক কাঠামো খুব নাজুক।
কিন্তু এই সর্বনাশের জন্য শিল্প-প্ররোচিত দূষণই কেবল দায়ী? নাকি শিল্পায়ন ও উন্নয়নের বিষাক্ত চক্রকে সক্ষমকারী আদর্শও সমান দায়ী?
যেমন এক সময় সুবে বাংলার জনগোষ্ঠী নিজস্ব ভূখণ্ডেই ঔপনিবেশিত হয়ে পড়েছিল। উপনিবেশবাদী ব্রিটিশরা তাদের সভ্যতার অনুশীলন চাপিয়ে দিয়েছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর।
ঔপনিবেশিকতার সবচেয়ে প্রভাবশালী যে উত্তরাধিকার এখনও আমাদের তাড়া করে, তা হলো জ্ঞান ব্যবস্থা। এই জ্ঞান ব্যবস্থা প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমাবদ্ধ করে তোলে। ঔপনিবেশিক প্রকল্পের সাফল্য নিহিত এখানেই।
এই বিশেষ চিন্তা-ভাবনা যে কোনো মূল্যে পুঁজি সঞ্চয়কে উৎসাহিত করে। কেবল এখানে নয়, বিস্ময়করভাবে প্রকৃতির ওপর পুঁজির প্রাধান্য বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই গভীর ছাপ ফেলে রেখেছে।
ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞানের আলোকে যদি জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক আলোচনায় যাওয়া যায়, দেখা যাবে সেখানকার মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যে বিভাজন।
এই চিন্তা-ভাবনা মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয়েছে; মানুষ ও প্রকৃতিকে আলাদা সত্তা হিসেবে দেখা হয়েছে। যেমন ‘প্রকৃতি’ শব্দটিই মানুষের আরোপিত। প্রকৃতি নিজে এই পরিচয় তৈরি করেনি।
আমাদের চারপাশের বন, নদী, বাতাসকে আমরা সাধারণীকরণ করে ‘পরিবেশ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছি। এই বিভাজন এমন ধারণার দিকে ঠেলে দেয়, মানুষ তার চারপাশের ‘প্রকৃতি’ থেকে আলাদা।
অথচ পরিবেশ বলতে যা বোঝায়, এর অন্যান্য সদস্যের মতো মানুষও একটি সদস্য মাত্র। অথচ মানুষ জন্মগতভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত। যখন প্রকৃতিকে সাংস্কৃতিকভাবে মানুষ থেকে বিভাজিত করা হয়, তখন বিভাজনের অন্যান্য প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে।
মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল– ধারণাটাও সঠিক নয়। বরং মানুষ ও প্রকৃতি একই গোত্রের। সেটাই সঠিক।
প্রকৃতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিভাজনের পথ ধরে এসেছে ‘প্রকৃতি রক্ষা’ করার জন্য নানা আইন ও বিধি-বিধান। আমাদের দেশের সংবিধানসহ মৌলিক আইনগুলো যে কারণে এমনভাবে প্রণীত, যা পরিবেশকে নাগরিকের অবস্থান থেকে আলাদা করে রাখে। এসব আইন ও বিধান মূলত মানুষকে পরিবেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত থাকার অধিকারকে অগ্রাহ্য করে।
আরও পরে গিয়ে আইন ও বিধানগুলো ‘প্রকৃতি’ ধারণার মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করে। যেমন পরিবেশ নিয়ে আলাদা আইন, বন নিয়ে আলাদা আইন, পানি নিয়ে আলাদা আইন।
অথচ মানুষকে আলাদা করার পরও অন্তত এগুলো আন্তঃসম্পর্কিত হওয়া বা অভিন্ন আইনের মধ্যে থাকা উচিত। এই বিভাজনবাদী চিন্তার নেপথ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবদান।
পরিবেশ বা প্রকৃতি রক্ষায় বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগী বা আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর কাজের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেগুলোর মধ্যেও বিভাজন রয়েছে।
এমনকি স্থানীয় প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এমন প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকে, যার সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সম্পর্ক নেই। কারণ এসব প্রকল্পের নকশা নেওয়া হয় বিদেশি কোনো প্রকল্পের নকশা থেকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও যেসব শঙ্কার কথা বলা হয়, সেখানে যতখানি না স্থানীয় প্রভাব বিবেচিত, তার চেয়ে বেশি বিবেচনা করা হয় বৈশ্বিক প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত অভিঘাত বিবেচনার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বা পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনা বা জ্ঞান প্রয়োগ কখনও কখনও মুখ্য হয়ে ওঠে।
যদিও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি জলবায়ুকর্মীরা দেশের নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরে; স্থানীয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার প্রশ্ন একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় হয়ে ওঠে। সামগ্রিক শাসন কাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা অর্থনীতি থেকে অনেক দূরের বিষয় হয়ে ওঠে।
ইতিহাস গভীরভাবে চর্চা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর ভূ-চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে মানব জাতির কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যে স্থানীয় সভ্যতার সম্পর্ক রয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, বিশ্ব এমন একটি দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে, যা একই সঙ্গে সর্বব্যাপ্ত এবং স্থানীয় শর্ত ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।
এই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন বা এর অভিঘাতকে বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার মৌলিক পদ্ধতি আবিষ্কার করা। ক্ষমতাচ্যুত সরকার যেভাবে ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’ নিয়েছিল, সেটা তেমন নাও হতে পারে।
প্রকৃতিকে ‘অপর’ করে না দিয়ে বরং মানুষ ও প্রকৃতিকে একক সত্তা হিসেবে চিন্তা করে সেই মৌলিক পদ্ধতি সামনে আনতে পারে। জলবায়ু যেমন, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় যেন জনসাধারণের নিয়মিত জীবনযাত্রা থেকে ভিন্ন কিছু না হয়।
আমরা জানি, ফ্যাসিবাদী শাসনকালে মানুষ ও প্রকৃতি কেবল নয়, সবকিছুর মধ্যেই বিভাজন রেখা তুলে দেওয়ার প্রবণতা ছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পরও আমরা কি সেই বিভাজনের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসব না?
জলবায়ু পরিবর্তনকে অন্যান্য সংকট থেকে আলাদা করে দেখানোর বিভাজন রেখা মুছে দিয়েই সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু হতে পারে। কারণ আমাদের দেশে নদ-নদী, জমিজমা, ফসল, বৃক্ষ, পশু-পাখি নিয়েই তো প্রকৃতি ও এর জলবায়ু!
বর্তমান অন্তবর্তী সরকার সংস্কারমূলক অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দার্শনিক ধারণার বিভ্রান্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার বিষয়ও আনা অতি আবশ্যক।
ড. সাদ কাশেম: ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের লেকচারার , (সমকাল প্রত্রিকায় প্রকাশিত)