সুপারি উৎপাদনে দেশের শীর্ষ জেলা লক্ষ্মীপুর

হাটের দিন গ্রামের শিশু, কিশোর, যুবক এবং বৃদ্ধ সবার হাতে হাতে সুপারির ব্যাগ। মৌসুমে ৬০০ কোটি টাকার বাজার, ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান।

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

বাংলাদেশের যে জেলায় প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি সুপারি গাছ রয়েছে—সেটি হলো লক্ষ্মীপুর। শুধু সৌন্দর্য নয়, অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে এই ছোট্ট একটি ফল।

বাজার ঘুরে দেখা যায়—শিশু, কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই সুপারি নিয়ে ব্যস্ত। হাটের দিন পুরো এলাকা যেন হয়ে ওঠে সুপারির উৎসবমুখর জনপদ।গ্রামের শিশু, কিশোর, যুবক এবং বৃদ্ধ সবার হাতে হাতে সুপারির ব্যাগ।

চারিদিকে শুধু সুপারি আর সুপারি। লক্ষ্মীপুর জেলার কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

 সুপারিতে দেশের এক নম্বর জেলা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ‘কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০২৩’ অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্মীপুর জেলায় উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩১ টন সুপারি। বাজারমূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা (প্রতি কেজি ২৫০ টাকা ধরে)।

বাংলাদেশে সুপারি উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে কক্সবাজার (৫৯,২৯৩ টন), তৃতীয় চাঁদপুর (২৩,৭৪৩ টন) এবং চতুর্থ ভোলা (১৪,৩৩৪ টন)। সবচেয়ে কম উৎপাদন চাঁপাইনবাবগঞ্জে—মাত্র ১৯ টন।

দেশের সবচেয়ে কম সুপারি উৎপাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে।গত বছর মাত্র ১৯ টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে এই জেলায়।

বিশ্ব পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ দ্বিতীয়

বিশ্ব অর্থনৈতিক জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘ট্রিজ’ জানিয়েছে, বিশ্বে সুপারি উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

  • ১ম: ভারত – ১.৭ বিলিয়ন কেজি।
  • ২য়: বাংলাদেশ – ৩৩৩.৭ মিলিয়ন কেজি।
  • ৩য়: মিয়ানমার – ২৩৬ মিলিয়ন কেজি।

প্রতি বাড়িতে গাছ’—সামাজিক মর্যাদার প্রতীক

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, লক্ষ্মীপুরের প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি সুপারি গাছ রয়েছে। জেলার রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলা আকাশ থেকে দেখলে মনে হয় এক বিশাল সুপারি বাগান। গাছ থাকা শুধু আর্থিক নিরাপত্তা নয়, একটি সামাজিক মর্যাদাও।

মৌসুমে ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান

জেলার অন্তত ২০টি বড় হাটে সুপারিকে ঘিরে মৌসুমজুড়ে গড়ে ওঠে অস্থায়ী কর্মসংস্থান। শ্রমিক, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক মিলে প্রায় ৫ হাজার লোক সরাসরি যুক্ত থাকেন এই অর্থনীতির সঙ্গে।

দাম দ্বিগুণ, আয় বেড়েছে

সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে সুপারি মৌসুম। এবার ফলন কম হলেও দাম বেড়েছে।

  • প্রতি পন (৮০টি বা ২০ গন্ডা) বিক্রি হচ্ছে ২০০–২৫০ টাকায়।
  • প্রতি কাওন (১৬ পন) বিক্রি ১৮০০–২০০০ টাকায়।

সদর উপজেলার চররুহিতা এলাকার ফারুক হোসেন শিহাব জানান, তার ৪৫৮টি গাছে এবার ৩–৪ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছেন। আরও কিছু বিক্রি বাকি রয়েছে।

সুপারির তিন ধরন

দালাল বাজারের বাসিন্দা আবদুল কাইয়ুম রিগ্যান জানালেন, তিন ভাবে সুপারি বাজারে আসে— কাঁচা (সবুজ), পাকা (হলুদাভ) এবং ভেজানো (সংরক্ষিত)। তিন ধরণেরই রয়েছে বাজারে চাহিদা।

কিশোরদেরও ব্যস্ততা

কিশোররা ১০ টাকা পারিশ্রমিকে গাছে উঠে সুপারি নামিয়ে আনে। তারপর থোকা থেকে ছাড়ানো, গণনা, হাটে আনা—সবই স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে।

৬,৮৭৬ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলার ৬,৮৭৬ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন গাছের সংখ্যা।

ঔষধেও সুপারির ব্যবহার

ভারতের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম IndiaMART সূত্রে জানা গেছে, সুপারির রয়েছে প্রায় শতাধিক ব্যবহার। শুধু পানের উপকরণ নয়, ঔষধ তৈরিতেও সুপারির ব্যবহার হয়। পৃথিবীর কিছু দেশে সুপারিকে মাদক হিসেবেও গণ্য করা হয়।

সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

উদীচীর জেলা সমন্বয়ক অধ্যাপক কার্তিক সেন গুপ্ত বলেন, “বাঙালি সংস্কৃতির অংশ পান-সুপারি। অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার এক ঐতিহ্য।”

বিশেষজ্ঞ মত বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন,“সুপারি অর্থনীতি লক্ষ্মীপুরকে অকাতরে টাকা দিচ্ছে। একটি সুপারি গাছ ৩–৪ বছরেই ফল দেয়, আর ফলন চলে ৪০–৫০ বছর পর্যন্ত।”


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন