প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অপরিসীম। দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৫.২৭ শতাংশ কৃষিখাতে নিয়োজিত এবং জিডিপির প্রায় ১১.৫৫ শতাংশ আসে কৃষি থেকে।

তবে প্রচলিত কৃষি পদ্ধতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, যেমন রাসায়নিক সার ও ভূগর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় ব্যবহার, কৃষিকে দিন দিন টেকসইহীন করে তুলছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬.৯ মিলিয়ন টন সারের ৮০ শতাংশ আমদানি করে এবং দেশের ভূগর্ভস্থ পানির ৯০ শতাংশই কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর ও যশোরের মতো জেলাগুলো প্রায়ই পানির সংকটে পড়ে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার (PA) একটি যুগান্তকারী সমাধান হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

এটি হলো আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি পদ্ধতি, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশগত ক্ষতি হ্রাস করে। সেন্সর, স্যাটেলাইট, ড্রোন ও জিপিএস-নির্ভর যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মাঠ পর্যবেক্ষণ সহজ ও সুনির্দিষ্ট হয়।

উদাহরণস্বরূপ, মাটির আর্দ্রতা পরিমাপক সেন্সরের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সেচ দিয়ে ৩০-৪০ শতাংশ পানি সাশ্রয় করা যায়। একইভাবে ড্রোন ও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ফসলের রোগ-বালাই, পুষ্টির ঘাটতি শনাক্ত করা যায়।

জিপিএস ও সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্য কৃষকদের সার প্রয়োগে বৈচিত্র্য বুঝতে সাহায্য করে, যা অপচয় কমায় এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে। এছাড়াও, মাটির পিএইচ, পুষ্টি উপাদান ও জৈব পদার্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

সেন্সরের মাধ্যমে পাওয়া রিয়েল-টাইম তথ্য সফটওয়্যার ও এআই ব্যবহার করে সেচ, সার ও কীটনাশক ব্যবহারে সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। এমনকি এই প্রক্রিয়াগুলোর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনাও সম্ভব, যা শ্রম ব্যয় হ্রাস করে।

বাংলাদেশে প্রচলিত বৃষ্টিনির্ভর ধান চাষ পদ্ধতি (flooded irrigation) মাটিতে অক্সিজেনহীন পরিবেশ তৈরি করে, যা মিথেন গ্যাস উৎপাদন করে—এই গ্যাস কার্বন ডাই–অক্সাইডের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি ক্ষতিকর।

আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IRRI) জানায়, দেশের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ২১ শতাংশ আসে ধান চাষ থেকে। এছাড়া ডিজেলচালিত সেচপাম্প ব্যবহারে কার্বন নির্গমন বাড়ে এবং গ্রামীণ এলাকায় বায়ুদূষণ বাড়ে।

এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IRRI) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) কর্তৃক প্রবর্তিত অল্টারনেটিভ ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (AWD) পদ্ধতি ইতোমধ্যে টেকসই সেচ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর সঙ্গে প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার (PA) প্রযুক্তি যুক্ত করলে ফলন বৃদ্ধি, পানি ও সার ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মিথেন নিঃসরণ কমানো সম্ভব।

অল্টারনেটিভ ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (AWD) ব্যবহারে ৩০–৪০ শতাংশ পানি সাশ্রয় ও ২০–৩০ শতাংশ সার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন সম্ভব, ফলে ধান উৎপাদন ১০–২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও নেদারল্যান্ডসে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার ব্যবহারে রাসায়নিক অপসারণ কমে এবং পানি ব্যবহার ২০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়।

এজন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন পাইলট প্রকল্প, যেখানে বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও ডেমো খামারের মাধ্যমে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো হবে। উপজেলা পর্যায়ের কৃষি অফিসগুলো এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

অঙ্কুর, আইফার্মার এবং ড্রিপ ইরিগেশন বিডি লিমিটেড–এর মতো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে IoT-নির্ভর সেবা দিয়ে কৃষকদের প্রিসিশন কৃষিতে সহায়তা করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তির ব্যবধান দূর করছে এবং জাতীয়ভাবে প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার (PA) প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে।

কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (BADC), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে নীতিগত ও আর্থিক প্রণোদনা তৈরির মাধ্যমে প্রিসিশন কৃষির বিস্তার ঘটানো সম্ভব।

সরকারি-বেসরকারি ও কৃষকদের মধ্যে সহযোগিতা তৈরি করে বাংলাদেশ একটি সহনশীল, টেকসই এবং উৎপাদনশীল কৃষির মডেল গড়ে তুলতে পারে।

সার্বিকভাবে, খাদ্য নিরাপত্তা, উৎপাদন খরচ কমানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার বাংলাদেশের জন্য অত্যাবশ্যক। প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও নীতিমালায় বিনিয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে বদলে দেওয়া সম্ভব।

লেখক: ড. সুলতান আহমেদ, অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (BIGM)। আফসানা আক্তার, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (BIGM)।

দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন