নিজস্ব প্রতিবেদক:
আশির দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাঠজুড়ে দেখা মিলত ধবধবে সাদা তুলার। মাঝখানে বাজার অব্যবস্থাপনার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন কৃষকরা। তবে সরকারি প্রণোদনা, উন্নত বীজের সহজলভ্যতা এবং তুলার সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে সবজি চাষের সুযোগ থাকায় আবারও সুদিন ফিরছে এই অর্থকরী ফসলটির।
যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা—এই চার জেলায় চলতি মৌসুমে তুলার আবাদ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় কৃষকরা আবারও ঝুঁকছেন ‘সাদা সোনা’ খ্যাত এই ফসল চাষে।
চাহিদা বনাম উৎপাদন: আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ
দেশে প্রতি বছর তুলার চাহিদা থাকে প্রায় ৭৩-৭৪ লাখ বেল (১৮২ কেজিতে ১ বেল)। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার বেল। অর্থাৎ মোট চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়, বাকিটা আমদানি করতে হয়।
এই বিশাল ঘাটতি মেটাতে ও আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকার তুলা চাষে জোর দিয়েছে। চলতি মৌসুমে সারাদেশে ১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, যার সিংহভাগই পেয়েছেন যশোর জোনের চাষীরা।
বাড়ছে আবাদ ও কৃষকের আগ্রহ
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে।
- চলতি মৌসুম: ২০,০০০ হেক্টর
- গত বছর: ১৯,২০০ হেক্টর
- ২০২২-২৩ অর্থবছর: ২,৬০০ হেক্টর (উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়)
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার রঘুনাথনগর গ্রামের তুলাচাষী সাইফুল ইসলাম বলেন, “এক বিঘা জমিতে তুলা চাষে ১৪-১৮ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় খরচ বাদে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ থাকে।”
আরেক চাষী আমিনুর রহমান জানান, তিনি ২২ শতক জমিতে তুলা চাষ করেছেন। সরকারি প্রণোদনা হিসেবে ৩০ কেজি ডিএপি, ৩৫ কেজি পটাশ, ১৪ কেজি ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম বীজ ও কীটনাশক পেয়েছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও ভালো হয়েছে।
মাঠ থেকেই বিক্রি, তবে দাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সরকার প্রতি মণ তুলার দাম ৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তুলা চাষের বড় সুবিধা হলো, এটি বিক্রি করতে বাজারে নিতে হয় না; ক্রেতারা ক্ষেত থেকেই কিনে নিয়ে যান।
তবে দাম নিয়ে কৃষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। চাষী শহিদুল ইসলাম বলেন, “তুলার যে দাম সরকার নির্ধারণ করেছে তা আরও বাড়ানো দরকার। তুলা চাষে আট মাস সময় লাগে। দাম না বাড়ালে কৃষকের লাভ কমে যাবে।”
এ বিষয়ে যশোর জোনের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, “তুলা একটি আন্তর্জাতিক পণ্য। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করেই সরকার দাম নির্ধারণ করে, এখানে সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই। আমরা হাইব্রিড জাত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি।”
কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল আমীন জানান, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং চাষে উৎসাহ দিতে যান্ত্রিকীকরণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যশোর জোনের ২ হাজার ৬০০ কৃষককে বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনা হয়েছে।
অন্যদিকে, সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য অধ্যাপক এএসএম গোলাম হাফিজ নীতিমালার সংস্কার দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন নীতিমালায় তুলাচাষীদের ঋণের বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। এটি পরিবর্তন করে তাদের জন্য আলাদা ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে চাষের পরিধি আরও বাড়ে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, লাভজনক ফসল হওয়ায় এবং সরকারি সহায়তা পাওয়ায় কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন। এই অঞ্চলের তুলার মানও বেশ ভালো।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.