পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, তবুও আমদানির প্রয়োজন কেন?

স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে বড় অগ্রগতি, সমস্যা সংরক্ষণ ও ন্যায্য দাম। বাংলাদেশ এখন পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে শক্ত অবস্থানে। গবেষণা, প্রযুক্তি ও সরকারিভাবে প্রণীত পদক্ষেপের কারণে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। তবে ন্যায্য মূল্য না পেলে এই অগ্রগতি স্থায়ী হবে না।

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—আমদানির তালিকাতেও রয়েছে দেশটির নাম। স্থানীয় উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, তবুও দেশের মোট চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

কারণ দেশের মোট চাহিদার পুরোটা এখনো পূরণ হয় না স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে। তাই বছর বছর আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে এর ঝাঁজ। কখনো চাহিদা বেড়ে গেছে, আবার কখনো দাম ছুঁয়েছে নাগালের বাইরে। ভারত নির্ভরতায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল দেশের পেঁয়াজ বাজার।

উৎপাদনের চেয়ে বেশি ঘাটতির কারণ—সংরক্ষণের অভাব

দেশের বার্ষিক পেঁয়াজ চাহিদা এখন প্রায় ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসেবে উৎপাদন চাহিদার চেয়েও বেশি। তবুও প্রতি বছর আমদানি হচ্ছে গড়ে ৭ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ!

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩৬ লাখ মেট্রিক টন হলেও এর ২৫-৩০ শতাংশ পেঁয়াজ পচে যায় বা নষ্ট হয়। এটাই তৈরি করে কৃত্রিম ঘাটতি, যার ফলে আমদানির প্রয়োজন দেখা দেয়।

উৎপাদনে বড় সাফল্য

গত এক দশকে দেশে পেঁয়াজের আবাদ প্রায় দেড় গুণ এবং উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যেমন:

  • ২০১৫-১৬: ২ লাখ ১৬ হাজার হেক্টরে উৎপাদন – ২১.৩ লাখ মে. টন
  • ২০১৯-২০: ২ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টরে – ২৫.৬ লাখ মে. টন
  • ২০২৪-২৫: উৎপাদন – ৪৪.৪৮ লাখ মেট্রিক টন (রেকর্ড)

পেঁয়াজ চাষে অগ্রণী জেলা—পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও রাজশাহী। শুধু পাবনায় আবাদ হয়েছে ৫২ হাজার হেক্টরে।

বারি পেঁয়াজ-৫: গ্রীষ্মকালীন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত ‘বারি পেঁয়াজ-৫’ জাতটি বছরে তিনবার চাষযোগ্য। এতে কম সময়ে, কম খরচে বেশি ফলন মিলছে।

পাবনার কৃষক শাজাহান আলী বাদশা বিঘায় প্রায় ২০০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করে আলোচনায় এসেছেন। এই জাতের দ্রুত বৃদ্ধি ও লাভজনক উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ছে।

গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সহায়ক ভূমিকা

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, “আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের লক্ষ্য নিয়েছে বাংলাদেশ। আমরা জলবায়ু সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করছি।”

উত্তরাঞ্চলে যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের চরে এখন পেঁয়াজ চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। স্যান্ডবার ক্রপিং পদ্ধতিতে এসব জমি থেকে মিলছে বাড়তি উৎপাদন।

সংরক্ষণ ব্যবস্থায় এয়ার-ফ্লো প্রযুক্তি

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দীন জানান, “প্রথম ধাপে দেশের পেঁয়াজ অধ্যুষিত এলাকায় ৪ হাজার এয়ার-ফ্লো মেশিন বসানো হয়েছে। এতে ২০-২২ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতি ঘরে প্রায় ৩০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ সম্ভব।”

এই পদ্ধতিতে পচন কমে এবং ওজন মাত্র ১০-১২% কমে। ফলে সংরক্ষণের সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠা যাচ্ছে।

 কৃষকের বীজ উৎপাদন ও খরচ কমানোর পদক্ষেপ

প্রতি বছর পেঁয়াজের বীজ আমদানিতে কৃষকদের খরচ পড়ত ৩-৩.৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন স্থানীয়ভাবে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—যাতে খরচ কমে ও নির্ভরতা হ্রাস পায়।

 দাম না পেলে চাষ কমে যাবে

এ বছর উৎপাদনে রেকর্ড হলেও, চাষের প্রতি কেজি খরচ ৪০-৪২ টাকা। অথচ পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়। খুচরা পর্যায়ে ৬০ টাকা হলে কৃষকের লাভ হতো।

যদি ন্যায্য দাম না মেলে, তাহলে পরের বছর পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ কমে যাবে—ফলে আবার আমদানিনির্ভরতা বাড়বে।


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন