চাষের মৃগেল মাছে FAO নির্ধারিত সীমার চার গুণ বেশি ক্রোমিয়াম! জানুন স্বাস্থ্যঝুঁকি, কারণ ও প্রতিকার—সম্পূর্ণ গবেষণা ভিত্তিক প্রতিবেদন। ক্যান্সারসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা, পুকুর পরিষ্কার না করাই অন্যতম কারণ।
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে আমিষের চাহিদার বড় অংশ এখন মাছ থেকেই পূরণ হচ্ছে। দেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়, যার ৬০ শতাংশই চাষের মাছ। তবে এ চাষের মাছ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ হয়ে আসছে।
সাম্প্রতিক একটি সরকারি গবেষণা বলছে, চাষের মৃগেল মাছে পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম—যার মাত্রা FAO নির্ধারিত সীমার চার গুণ বেশি। এ মাত্রার ক্রোমিয়াম মানবদেহে কিডনি, যকৃত, ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্রে গুরুতর ক্ষতি করতে পারে।
গবেষণার পেছনের গল্প: চাষের পাঁচটি মাছ নিয়ে বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (FRI) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নাটোরের একটি বাণিজ্যিক খামারের রুই, মৃগেল, সিলভার কার্প, বাটা ও পুঁটি মাছ নিয়ে গবেষণা করেন।
তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে:
- মৃগেল মাছে ক্রোমিয়াম: ০.৬৫৪ মিলিগ্রাম/কেজি।
- FAO নির্ধারিত সহনীয় মাত্রা: ০.১৫ মিলিগ্রাম/কেজি
→ অর্থাৎ প্রায় ৪ গুণ বেশি
এছাড়া মাছগুলোতে অন্যান্য ভারী ধাতুর উপস্থিতি ছিল নিম্নরূপ:
- রুই: ক্যাডমিয়াম – ০.০৩৪, আর্সেনিক – ০.০১৫।
- মৃগেল: ক্যাডমিয়াম – ০.০২৬।
- সিলভার কার্প: ক্যাডমিয়াম – ০.০১৭, আর্সেনিক – ০.০৩৩, সিসা – ০.৫৩৪।
- বাটা: ক্যাডমিয়াম – ০.০২৫।
- পুঁটি: ক্যাডমিয়াম – ০.০৪৯, নিকেল – ০.৮।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এগুলো ‘বিলো ডিটেকশন লিমিট (BDL)’ অর্থাৎ উপস্থিত থাকলেও যন্ত্রে সুনির্দিষ্ট পরিমাপযোগ্য নয় এমন মাত্রায়।
কেন বাড়ছে ভারী ধাতুর পরিমাণ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়ামুল নাসের বলেন— “মৃগেল সাধারণত পুকুরের তলদেশে বিচরণ করে। খামারিরা নিয়মিত পুকুর পরিষ্কার না করায় পচা খাদ্য ও বর্জ্যে ভারী ধাতুর ঘনত্ব বাড়ে। এ কারণেই এই মাছের শরীরে ধাতব উপাদান জমে থাকে।”
নাটোরের খামারি গোলাম নবী স্বীকার করেন, “আমরা অর্থনৈতিক ও সময়সীমার কারণে অনেক সময় পুকুর পরিষ্কার করতে পারি না। ফলে বর্জ্য জমে যায়, যা হয়তো মৃগেলের শরীরে প্রভাব ফেলছে।”
ক্রোমিয়ামের স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ক্রোমিয়ামকে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে (carcinogen) বলে ঘোষণা করেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে—
- কিডনি ও লিভারের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে।
- ত্বকে প্রদাহ, ফুসকুড়ি, স্নায়ুবিক জটিলতা।
- অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভস্থ সন্তানের বিকাশে বাধা।
তবে গবেষকরা বলেন— “FAO-এর তুলনায় মাত্রা বেশি হলেও WHO অনুযায়ী ১ মিলিগ্রাম/কেজির নিচে থাকলে তা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবুও এটি একটি সতর্কতা সংকেত।”
কিভাবে ঝুঁকি কমানো যায়?
FRI-এর সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রবিউল আউয়াল হোসেন বলেন, “ফিড নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যেসব মাছকে আমরা প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়াচ্ছি, সেগুলোর গুণমান যাচাই করা জরুরি।”
সুপারিশ:
- মাছের কাঁটা ও চামড়া বাদ দিয়ে শুধু মাংস খেলে ঝুঁকি অনেকটাই কম।
- পুকুর নিয়মিত পরিষ্কার করা।
- বালাইনাশক ও ফিডে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ
ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা
এ গবেষণা ও ফলাফলগুলো দেশের চাষের মাছের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের বলেন—“চাষের মাছ সাধারণত নিরাপদ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন যেহেতু ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে, এটিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। এখনই সময় গবেষণা, নীতি গ্রহণ ও খামার ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বনের।”
মাছ আমাদের আমিষের অন্যতম উৎস। তবে যদি চাষের মাছেই নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, তাহলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এখন সময়—মৎস্য খাতে প্রযুক্তিনির্ভর তদারকি, ফিড ও পানি ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি বাস্তবায়নের।
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.