এম. খছরু চৌধুরী
হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। ছোট হাওরগুলো হিসাবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে এ সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে যাবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কবিয়ালরা একসময় গান গাইতেন– ষোলশত নদীর মাঝে ব্রহ্মপুত্র রাজা।
দখল ও দূষণে নদীর পাশাপাশি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হাওরের সংখ্যাও কমেছে। দেশের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হেটেরোজেনাস বা অসমসত্ত্ব। এই বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখতে না পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অনন্তকালের জন্য হারিয়ে যেতে পারে।
হেটেরোজেনাস বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে হলে বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে প্রকৃত অর্থেই নদী ও নদীর নাব্যসহ প্রবাহ, হাওর-খাল-বিল-জলাভূমি ও পাহাড়-পাহাড়ি ছড়া-ঝর্ণার প্রকৃতি প্রদত্ত গঠন ধরে রাখায় যত্ন নিতে হবে।
২০১২ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর পরিবেশ-কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদসহ অনেক মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর-পরিদপ্তর এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ মতের ভিত্তিতে হাওর উন্নয়নবিষয়ক ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে।
দুই শতাধিক পৃষ্ঠার মাস্টারপ্ল্যানে হাওর পরিবেশ সংরক্ষণে হেন কোনো ভালো কথা নেই, যা এখানে বলা হয়নি। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? হাওর-পরিবেশ ও এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে যেসব ভালো কথা বলা হয়েছে, মূলত এর বিপরীতে হাওরের জীববৈচিত্র্য পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের সব কর্মযজ্ঞই পরিচালিত হচ্ছে সরকারের তালিকাভুক্ত হাওরগুলোতে।
তা ছাড়া সম্প্রতি এক খবরে দেখলাম, ৩৭১টি হাওরের সীমানা নির্ধারণের কথা বলেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা। ভূমি, পরিবেশ সংরক্ষণের আইন-বিধি, দায়িত্বশীলদের কথাবার্তা শুনে ও উন্নয়নের কেতাব পড়ে বোঝার উপায় নেই, এদের চোখের সামনেই বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যক্তিমালিকরা ধ্বংস করছেন হাওর ও জলাভূমি।
হেটেরোজেনাস ভূ-কাঠামো সংরক্ষণে হাওর ও জলাভূমি সংরক্ষণ কেন জরুরি? কারণ এর সঙ্গে সম্পর্কিত এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু।
এসব হাওর ও জলাভূমি আমাদের পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে। বর্ষাকালে এসব হাওর ও জলাশয় ব্যাপক পানি ধারণ করে বন্যার হাত থেকে জনবসতিকে সুরক্ষা দেয়; তেমনি শুষ্ক মৌসুমে নদীর পাশাপাশি এসব হাওর-জলাভূমির পানি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
হাওর ও জলাভূমি পরিবেশ ভারসাম্য সুরক্ষায় প্রকৃতির কিডনির ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ-প্রতিবেশ বজায় রাখতেও হাওরের ভূমিকা অপরিসীম। মৌলভীবাজার জেলায় এ রকম বড় তিনটি হাওর হলো হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওর।
এশিয়ার মিঠাপানির সবচেয়ে বড় রিজার্ভার হাকালুকি হাওর। এ হাওর নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা আছে, তবে বাস্তবায়ন নেই। আন্তঃদপ্তরের সমন্বয়হীন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনায় বছর বছর ছোট হয়ে আসছে হাওরের পরিধি।
কয়েক দশক থেকে কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার বন্যার প্রধান কারণ বুড়িকিয়ারী খালের বাঁধ। অর্থাৎ হাওরের পানি কুশিয়ারা নদীতে নামে এই বুড়িকিয়ারী খাল দিয়ে। শুষ্ক মৌসুমে হাকালুকি হাওরে মাছ ধরার গোষ্ঠী-সুবিধার্থে এ বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে পানির দ্রুত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে। এতে বন্যার সৃষ্টি করা হয়েছে।
জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম হাওরের নাম হাইল হাওর। ১৩০টি বিল আর তিন দিক থেকে নেমে আসা ৩৫২টি ছড়ার পানিপ্রবাহ ধারণ করে এ হাওর। এতে রয়েছে মাছের অভয়াশ্রমখ্যাত বিখ্যাত বাইক্কা বিল।
হাওরে শীত মৌসুমে থাকে অতিথি পাখির দৃষ্টিনন্দন আগমন। নব্বই দশকের শুরুতে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন ও পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে এ হাওরে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করা হয় ফিশারিজ প্রকল্প, যা এখনও অব্যাহত।
দুই বছর ধরে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানির হবিগঞ্জ অ্যাগ্রোজ লিমিটেড নিজস্ব ক্রয়কৃত ভূমির পাশাপাশি ব্যাপক খাসজমি দখল করে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ হাওরের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করছে। অর্ধেক ছোট হয়ে আসছে হাওরের পরিধি।
জেলার তৃতীয় বৃহত্তম কাউয়াদীঘি হাওরটি ঘিরে রয়েছে দেশের কৃষি উন্নয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম মনু সেচ প্রকল্প। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইস্তাম্বুল ভার্সিটির যৌথ গবেষণা বলছে, বছরে সাড়ে ১০ লাখ মানুষের মিঠাপানির মাছের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম এ হাওর।
বিকল্প জায়গা থাকতেও সাম্প্রতিক সময়ে হাওরের মাঝখানে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন সরকার। প্রকল্পে পৌঁছানোর সম্ভাব্য লিংক রোডের দু’পাশে হাওরের মাঝখানে বহুজাতিক কোম্পানি দেদার ক্রয় করে নিয়েছেন হাজার হাজার একর বোরো ধানের জমি।
কোনোরূপ ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া এমন অপরিণামদর্শী উন্নয়নে কাউয়াদীঘি হাওরের ২৩০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছই শুধু ধ্বংস হবে না; ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ।
হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যান, ভূমি ও পরিবেশ-সংক্রান্ত আইন-বিধি উপেক্ষা করে প্রকৃতির কিডনি (হাওর) যারা নষ্ট করছেন; এসবের দায় কার? ৫৩ বছরের শাসকগোষ্ঠীর লুটেরা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আর বাগাড়ম্বরের ধরন যদি একই থাকে, তাহলে ৫ আগস্টের পরিবর্তনটা আসলে কী?
এম. খছরু চৌধুরী: হাওর রক্ষা আন্দোলন, মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সদস্য সচিব। সমকালে প্রকাশিত
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.