রংপুর প্রতিনিধি:
গাছটি দেখতে অনেকটা ঝাউ গাছের মতো, কিন্তু এটি সাধারণ কোনো গাছ নয়। এর নাম ‘টি-ট্রি’ (Tea Tree)। অস্ট্রেলিয়ার এই দুর্লভ প্রজাতির গাছের পাতা থেকে উৎপাদিত হয় মহামূল্যবান এসেনশিয়াল অয়েল, যার প্রতি লিটারের বাজারমূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। শুধু তেল নয়, তেল উৎপাদনের সময় উপজাত হিসেবে পাওয়া ‘হাইড্রোসল ওয়াটার’ও বিক্রি হয় হাজার টাকা লিটারে। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নিভৃত পল্লীতে এই মূল্যবান গাছের সফল চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ।
উদ্যোক্তার গল্প: তাইওয়ান থেকে রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে
তরুণ উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান আরিফের বাড়ি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হরিশ্বর গ্রামে। তিনি তাইওয়ানের একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে থাকাবস্থায় টি-ট্রি অয়েলের গুরুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে পারেন। মাথায় চাপে দেশে এই গাছ চাষের ভাবনা।
চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের শ্রীকান্ত গ্রামে এক একর জমি লিজ নেন। কিন্তু শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। বিদেশ থেকে চারা আনতে না পেরে ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে বীজ সংগ্রহ করেন। সেই বীজ থেকে চারা উৎপাদন করতে গিয়ে বহুবার ব্যর্থ হন, তবে হাল ছাড়েননি। স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটের পরামর্শে অবশেষে ৪০টি চারা বাঁচাতে সক্ষম হন। সেই ৪০টি চারা থেকে কাটিং পদ্ধতিতে গত তিন বছরে তার বাগানে এখন গাছের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি।
হাইলাইটস
- গাছের নাম: অস্ট্রেলিয়ান টি-ট্রি।
- পণ্যের ধরণ: এসেনশিয়াল অয়েল ও হাইড্রোসল ওয়াটার।
- মূল্য: তেল ৫০,০০০ টাকা/লিটার; পানি ১,০০০ টাকা/লিটার।
- বিনিয়োগ: ১৫ লাখ টাকা।
- সম্ভাব্য আয়: চলতি বছর ৩০ লাখ টাকা।
- রপ্তানি: থাইল্যান্ড ও তাইওয়ান।
প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্রযুক্তি
সরেজমিনে দেখা যায়, বাগানের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে তেল নিষ্কাশনের অত্যাধুনিক প্ল্যান্ট। চীন থেকে একটি ছোট মেশিন এনে তার আদলে স্থানীয়ভাবে ৫০০ লিটার ধারণক্ষমতার স্টিম ডিস্টিলেশন মেশিন তৈরি করেছেন আরিফ।
প্রক্রিয়া সম্পর্কে শ্রমিকরা জানান, গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের পর তা ধুয়ে মেশিনে দেওয়া হয়। এরপর চার-পাঁচ ঘণ্টা তাপ দিয়ে ‘স্টিম ডিস্টিলেশন’ বা বাষ্পীয় পাতন পদ্ধতিতে তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার আলাদা করা হয়। প্রতি ব্যাচে ৫০ কেজি পাতা থেকে গড়ে ১০ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। দিনে তিন ব্যাচে প্রায় দেড় লিটার তেল উৎপাদন সম্ভব।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও রপ্তানি
একসময় টি-ট্রি অয়েল পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন আরিফের উৎপাদিত তেল ও পানি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানে।
উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান আরিফ বলেন, “শুরুতে গ্রামের মানুষ বিশ্বাসই করত না যে গাছের পাতা থেকে তেল হয়। ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে শুরু করা এই প্রজেক্ট থেকে এ বছর ৩০ লাখ টাকা আয়ের আশা করছি। গত তিন বছরে প্রায় ৫০ লিটার তেল ও ৫ হাজার লিটার হাইড্রোসল ওয়াটার উৎপাদিত হয়েছে।”
ব্যবহার ও উপকারিতা
টি-ট্রি অয়েল ও হাইড্রোসল ওয়াটার বিশ্বব্যাপী প্রসাধনী ও ওষুধ শিল্পে ব্যাপক সমাদৃত।
- ত্বকের যত্ন: ব্রণ, ফাঙ্গাস ও ত্বকের সতেজতা বজায় রাখতে কার্যকর।
- চুলের যত্ন: খুশকি দূর করা, চুল পড়া রোধ ও স্ক্যাল্পের সমস্যায় এটি দারুণ কাজ করে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দাবি
আরিফ স্বপ্ন দেখেন বৃহৎ পরিসরে টি-ট্রি চাষ করে আরও মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার। তবে রপ্তানি প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় বাধার মুখে পড়ছেন। তিনি বলেন, “সরকার যদি রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করে, তবে এই খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে।”
কৃষি বিভাগের বক্তব্য
পীরগাছা উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, “পীরগাছার মাটি টি-ট্রি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আরিফের এই উদ্যোগে আমরা শুরু থেকেই প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছি। অন্য কেউ যদি এমন উচ্চমূল্যের ফসল চাষে এগিয়ে আসেন, তবে কৃষি বিভাগ সব ধরনের সহযোগিতা করবে।”
Discover more from কৃষি প্রতিদিন
Subscribe to get the latest posts sent to your email.