কৃষিতে প্রযুক্তির বিপ্লব: ড্রোন, স্যাটেলাইট ও ডিজিটাল সেবা আনছে সরকার

সরকারি উদ্যোগে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি’ বাস্তবায়নে ১৭ জেলায় আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পে উপকৃত ৮০ হাজার কৃষক।

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাত কৃষি। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি খাতটি অনেকটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

এটি মোকাবিলায় সরকার ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (সিএসএ-ডব্লিউএমপি)’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

এই প্রকল্পের আওতায় ড্রোন, স্যাটেলাইট ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিকে আরও টেকসই, লাভজনক ও আধুনিক করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে সরকার কৃষকদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, শস্য চাষে বৈচিত্র্য আনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কমাতে অনাতে চাই।

প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিতে সরকারের পরিকল্পনা

  • প্রকল্প মেয়াদ ও ব্যয়: ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২6 সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই প্রকল্প, যার প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ১০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৮৪.৮ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকার ২১.২ কোটি টাকা।
  • কার্যক্রম এলাকা: দেশের ৮টি বিভাগের ১৭টি জেলার ২৭টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো— প্রকল্প এলাকায় আধুনিক ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন ও নিবিড়তা বাড়ানো। একই সঙ্গে সেচে পানির অপচয় কমিয়ে তা আরও দক্ষভাবে ব্যবহার করা, এবং উন্নত মানের দানাদার, ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা।

ড্রোন ও স্যাটেলাইটে মাঠ পর্যবেক্ষণ: কৃষির জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ

  • ৪টি উন্নত ড্রোন আমদানি।
  • ১৫ জন প্রশিক্ষিত ড্রোন পাইলট।
  • ড্রোন দিয়ে সার ছিটানো, ফসল পর্যবেক্ষণ ও দুর্গম এলাকায় কার্যক্রম তদারকি।

ফার্ম ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ ও সিদ্ধান্ত সহায়ক প্রযুক্তি চালু হচ্ছে

  • GIS, রিমোট সেন্সিং ও অটো মনিটরিং টুল ব্যবহারের প্রস্তুতি।
  • ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে হিসাব-নিকাশ, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ।

প্রধান সুবিধাভোগী কৃষকের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে

  • সরাসরি সুবিধা পেয়েছেন ৩০ হাজার কৃষক
  • পরোক্ষ উপকারভোগী আরও ৫১ হাজার

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার গনমাধ্যম বলেন, প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শস্য নিবিড়তায় ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি আনা। যা বাস্তবে অধিকাংশ উপজেলায় ৫ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি প্রকল্পের বড় সফলতা।

কৃষিবিদ খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক কৃষি উন্নয়ন ধারণা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে ফার্মার্স ক্লাইমেট স্মার্ট স্কুল, ফার্মার্স ক্লাইমেট স্মার্ট ক্লাব, ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষক, ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি গ্রাম, ফার্ম হাউজের বাণিজ্যিক মডেল, উৎপাদক সংঘ এবং কৃষি পণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র— এসবকে ভিত্তি করে একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক কৃষি কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে।

প্রকল্পটি পরিকল্পনা করা হয়েছে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক ও বুদ্ধিনির্ভর কৃষি সেবা, ফসলের যত্ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, জ্বালানি সাশ্রয় এবং আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশের নানা দিক মাথায় রেখে।

শুধু তাই নয়, প্রকল্পের আওতায় ফলবাগান ও সৌর পাম্প কেন্দ্রিক উৎপাদকদের নিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে উৎপাদক সংঘ। একই সঙ্গে উচ্চমূল্যের ফসল, দানাদার, ডাল ও তেলবীজ ফসলের উন্নত বীজ উৎপাদন, চারা উৎপাদন ও জৈব সার উৎপাদনভিত্তিক সংঘ গঠনের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থা সুসংহত হবে, অন্যদিকে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়াও নিশ্চিত হবে। এছাড়া মাঠ তদারকিতে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ফার্মহাউজ, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন কৃষিকে আরও গতিশীল ও আধুনিক করে তুলবে।

উৎপাদনশীলতা বাড়াতে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে:

প্রযুক্তি / কার্যক্রম উপকারিতা
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কম সময় ও শ্রমে চারা রোপণ
ফল বাগান স্থাপন বাণিজ্যিক ফল উৎপাদন
ভার্মি কম্পোস্ট নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব সার
পলিনেট হাউজ চারা উৎপাদনে উন্নত ব্যবস্থা
এডব্লিউডি ৩০% পর্যন্ত পানিসাশ্রয়
ড্রিপ ইরিগেশন বিন্দুতে সেচ দিয়ে পানি অপচয় রোধ
সৌর সেচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার
উচ্চমূল্যের ফসল চাষে কৃষকের আয় বাড়ছে
  • আদা, রসুন, পেঁয়াজ, গ্রীষ্মকালীন টমেটোসহ ২৭৩৬টি প্রদর্শনী।
  • জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে পরিবেশ সুরক্ষা।
  • বাজারে উচ্চ দামে বিক্রির সম্ভাবনা।
ভবিষ্যতের কৃষি: শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নীতি উন্নয়নের মডেল

প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখারের মতে, “এই প্রকল্প কেবল কৃষি প্রযুক্তি নয়, বরং একটি টেকসই কৃষি নীতিমালার রূপরেখা হিসেবে কাজ করছে।” মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, ক্লাইমেট স্মার্ট স্কুল ও ক্লাব, উৎপাদন কেন্দ্র ও ডিজিটাল কৃষিসেবা সংযুক্ত করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষিকে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষিত কৃষক গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রকল্প ২০৪১ সালের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে একটি কার্যকর মডেল হয়ে উঠছে। কৃষির উন্নয়ন মানেই দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি—এই লক্ষ্যেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

আরো পড়ুন 


Discover more from কৃষি প্রতিদিন

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন